শিক্ষাপ্রযুক্তি বিষয়ক ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’। যেখানে শিক্ষার্থীরা লাইভ ক্লাস, অনলাইন মক টেস্ট এবং অ্যানিমেশনের ফিচারসহ আলোচনায় সরাসরি যুক্ত হতে পারে। প্রস্তুত করে নিজেদের। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এই উদ্যোগের দুই স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন শাহীর ও জিসান। সম্প্রতি ফোর্বসের সম্ভাবনাময় স্টার্টাআপের তালিকায় স্থান পেয়েছে শিখো।
অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম শিখোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই লাইভ ক্লাসে যুক্ত হয়ে শিক্ষার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা লাভ করছে। শিখো ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের বাড়তি খরচ করে কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়তে হয় না। জটিল বিভিন্ন বিষয়কে অনলাইনে সহজ ভাষায় শেখানোর জন্য শিখো ডট কমের রয়েছে দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বা পাস করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে একদল দক্ষ শিক্ষক। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীদের সহজে অনলাইনে পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে ২০২০ সালে শিখো উদ্যোক্তারা চালু করেন শিখো অ্যাপ। এরই মধ্যে অ্যাপটি ১০ লক্ষ বার ডাউনলোড করা হয়েছে।
শুরুর তিন বছরের মধ্যেই ‘ফোর্বস এশিয়া ১০০ টু ওয়াচ’ শিরোনামের তালিকায় স্থান পাওয়া আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি ‘শিখো’ স্বপ্নদ্রষ্টাদের তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। প্ল্যাটফর্মটির ব্যতিক্রমী শিক্ষামূলক কনটেন্ট, অ্যানিমেটেড এবং অংশগ্রহণমূলক পাঠ, প্রয়োজনীয় কোর্স ও বিভিন্ন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা প্রদর্শনের জন্য গ্লোবাল ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ইতঃপূর্বেই ৫.৩ মিলিয়নেরও বেশি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় স্টার্টআপ শিখো
২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নিজেদের অর্থায়নে সর্বপ্রথম ‘শিখো’ এসএসসি শিক্ষার্থীদের জন্য সাধারণ গণিত বইয়ের ফুল সিলেবাসের ওপর ৭শ মিনিটের একটি কোর্স নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কোর্সটিতে ছিল- ১০৫টি অ্যানিমেশন ভিডিও, ৬৫টি বোর্ড পেপার এবং মক পরীক্ষা, আনুমানিক ৪ হাজারটি প্রশ্ন ও তার সমাধান, ৩১৫টি কুইজ এবং ১ হাজারের ওপর স্মার্ট নোট। শাহীর চৌধুরী ও জিশান জাকারিয়া নামক দুই তরুণ উদ্যোক্তার হাত ধরেই শিখো প্রতিষ্ঠিত হয়। শাহীর চৌধুরী বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন শিখোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে এবং শিখোর প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা (সিওও) হিসেবে আছেন জিশান জাকারিয়া।
শিখো হলো এমন একটি টিউটরিং প্ল্যাটফর্ম- যেখানে লাইভ লেকচার, অনলাইন মক টেস্ট, নোট এবং অ্যানিমেশনের ফিচারসহ বিশ্লেষণমূলক আলোচনার মাধ্যমে হাইস্কুলের পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা হয়। দৈনিক প্রায় পাঁচ লাখ ব্যবহারকারী রয়েছে শিখোর। বর্তমানে শিখোর মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। অভিজ্ঞ মেন্টর রয়েছে ৫০ জনের অধিক এবং লার্নিং ম্যাটেরিয়াল ১.৮ লাখ প্লাস। শিখোডটকমে বিনামূল্যে বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক ক্লাস করার সুযোগ রয়েছে। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চাইলেই ক্লাসগুলোতে অংশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান যাচাই করতে পারবেন। পড়ালেখার মান ভালো মনে হলে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কোর্সে নিবন্ধন করার সুযোগও রয়েছে অ্যাপটিতে । ‘শিখো’ মূলত দুই ধরনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেকোনো বিষয়ে সমাধান দিয়ে থাকে। তার মধ্যে একটি হলো অ্যানিমেশন লেসন এবং অপরটি অনলাইন কোর্স। মূলত প্রথম থেকে ‘শিখো’ অ্যানিমেশন লেসনের ওপর জোর দিয়েছে। কারণ শিক্ষার্থীরা যেন বইয়ের পড়াগুলো মজা করে পড়ে। বর্তমানে শিখো প্ল্যাটফর্মের এসএসসি, এইচএসসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ৯টি অ্যানিমেটেড কোর্স এবং ১৭টি অনলাইন কোচিং কোর্স। স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য বহুব্রীহির রয়েছে ৩৭টি প্রোফেশনাল কোর্স।
দুই স্বপ্নদ্রষ্টা
শিখো ডট কমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা (সিইও) শাহীর চৌধুরী বলেন, ‘দেশে একটি হাইপার-লোকালাইজড ডিজিটাল লার্নিং ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা এবং শেখার পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। আমরা মানসম্মত শিক্ষাকে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আরও উন্নতমানের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাই আমরা। পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন কঠিন বিষয় সহজ করে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরাই আমাদের মূল লক্ষ্য। যাতে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে পারে। আমাদের লক্ষ্য অনেক বিস্তৃত। সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমরাই প্রথম অ্যানিমেটেড ভিডিওর মাধ্যমে দেশে শিক্ষামূলক কনটেন্ট তৈরি করা শুরু করি। এর মাধ্যমে আমরা জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণির অধ্যায়ভিত্তিক বিষয়গুলো ভিজ্যুয়ালি উপস্থাপন করছি। ফলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত দেখে বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালোভাবে শেখার সুযোগ পাচ্ছে।’
শিখোর অন্য আরেকজন স্বপ্নদ্রষ্টা এবং বর্তমান সিওও জিশান জাকারিয়া বলেন, ‘গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতির বিকল্প নয়, বরং সম্পূরক হিসেবে আমরা কাজ করছি। আমাদের লাইভ ক্লাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ক্লাস শেষে শিক্ষকদের বক্তব্য রেকর্ডিং এবং ক্লাসনোট পাওয়া যায়। ফলে কারও সাহায্য ছাড়াই শিক্ষার্থীরা পরিপূর্ণভাবে বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখা করতে পারে। এ ছাড়াও শিখোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে। যার ফলে মূল পরীক্ষার আগেই নিজের অবস্থান একজন শিক্ষার্থী যাচাই করে নিতে পারে।’
অন্যান্য শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম থেকে কেন ‘শিখো’ আলাদা? এমন প্রশ্নের উত্তরে শাহীর চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা রিপোর্ট কার্ড থাকে। যেখানে মূলত একজন শিক্ষার্থী কোন কোন জায়গায় ভালো এবং কোন কোন জায়গায় খারাপ উভয় লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলস্বরূপ একজন শিক্ষার্থীর দুর্বলতা আমরা সহজেই চিহ্নিত করে তাকে যেমন গাইড করতে পারি একইভাবে তার ভালো জায়গাগুলো তুলে ধরে মোটিভেট করে থাকি। প্রতিটি ছাত্র থেকে ফিডব্যাক নেওয়া হয়। মূলত একজন ছাত্রের সমস্যা একদম গোড়া থেকে নির্মূল করার ওপর জোর দিয়ে থাকি।’
শুরুর দিকে শিখো শুধু মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্স পরিচালনা করত। তবে বর্তমানে সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণির জন্যও কনটেন্ট যুক্ত করেছে শিখো। পাশাপাশি ব্যক্তিগত/প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা উন্নয়নের বিভিন্ন কোর্সও চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সবার কাছে মানসম্পন্ন শিক্ষা পৌঁছে দিতে ভবিষ্যতে প্রকৌশল, মেডিক্যালসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোর্স চালু করারও পরিকল্পনা রয়েছে শিখো উদ্যোক্তাদের। বাংলাদেশের সবচেয়ে উন্নত শিক্ষাপ্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম শিখোর একমাত্র উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য হলো আপনার শেখার অভিজ্ঞতাকে আরও উপভোগ্য এবং কার্যকর করে তোলা। সর্বোচ্চ মানের শিক্ষার সংস্থানগুলোতে অ্যাক্সেসকে গণতান্ত্রিক করতে এবং বাংলাদেশে চিরকালের জন্য শেখার উপায় পরিবর্তন করতে চায় যুগান্তকারী এই প্ল্যাটফর্ম। ‘শিখো’ শিক্ষার সুবিধা সব জায়গায় পৌঁছে দিতে এবং একে আরও সুবিধাজনক ও ব্যয়সাশ্রয়ী করে তোলার রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফলস্বরূপ গত বছর গ্রামীণফোনের সঙ্গে একটি অ্যাডভান্সড লার্নিং টেকনোলজি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে শিখো পার্টনারশিপ চুক্তি সম্পাদন করেছে।
আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হওয়ার পর কেমন লাগছে? জবাবে শাহীর বলেন, ‘প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। মনে হয়েছিল পারব। কারণ আমরা যে প্ল্যানিং নিয়ে শিখো শুরু করেছিলাম ওই সময়ে বাংলাদেশে এমন কোনো প্ল্যাটফরম তৈরি হয়নি যারা অ্যানিমেটেড ভিডিও বানিয়েছে। যদিও এখনও আমাদের অনেক কাজ বাকি। আমাদের স্বপ্ন আরও বড়।’
Collected From PrroidinerBangladesh