বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় পড়েছিলেন রেজওয়ান করিম। বাবা ও দাদার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতে থাকেন বিমানে করে উড়ে বেড়াবেন বিশ্বের এ মাথা থেকে ও মাথায়। ইচ্ছা পূরণের স্বপ্ন নিয়ে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশুনা শেষ করেন। চেষ্টা করেন চাকরির জন্য। দেশকে ভালোবেসে বিদেশেও পাড়ি জমাননি। দেশের মধ্যেই তিনি তার পেশার চাকরি খুঁজেছেন। কিন্তু ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন ছিল না। শত চেষ্টা করেও নিজ স্বপ্নের পেশায় চাকরি পাননি রেজওয়ান। দেশের মধ্যে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে যখন ক্লান্ত তখন আবারও নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন তিনি। দেশে থেকেই কিভাবে আয় করা যায়, সেই পথ খুঁজেও বের করলেন। শুরু করলেন ফ্রিল্যান্সিং। শত বাঁধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি আজ সফল একজন ফ্রিল্যান্সার। কীভাবে তিনি এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন সে কথাই শুনিয়েছে আরটিভি নিউজের কাছে।
দীর্ঘ এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন তার জীবনের নানান কথা। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন আরটিভি নিউজের সহ-সম্পাদক জাহিদ হাসান।
আরটিভি: আপনার কাছে শুরুটা জানতে চাচ্ছি। কীভাবে আপনি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়তে আগ্রহী হয়েছিলেন?
রেজওয়ান করিম: অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য আমি আমার দাদার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন। আমার দাদা এখন বেঁচে নেই। এছাড়া আমার বাবাও বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চাকরি করছেন। এই দুজনের কাছ থেকেই অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার বিষয়ে উৎসাহ পাই। এজন্য ২০১১ সালে উত্তরার অ্যারোনটিক্যাল ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ (এআইবি) তে ভর্তি হই।
আরটিভি: বাংলাদেশে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ক্ষেত্রে কতটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে?
রেজওয়ান করিম: অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। তবে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু করে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টার (বিএটিসি)। এই প্রতিষ্ঠানটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিজস্ব ট্রেনিং সেন্টার। ১৯৮০ এবং ৯০ দশকের দিকে এই প্রতিষ্ঠান থেকে যারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত তারা সরাসরি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চাকরির সুযোগ পেত। আমার বাবা এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। এখান থেকে পড়াশুনা শেষ করে তিনি সরাসরি চাকরিতে যোগদান করেন। ২০০৫ সালের পর থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য বাংলাদেশে তিনটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আছে। যারা সিভিল এভিয়েশনের কাছ থেকে অনুমোদন পেয়েছে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টার (বিএটিসি), অ্যারোনটিক্যাল ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ (এআইবি) এবং মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)। এমআইএসটি সিভিল এভিয়েশনের অনুমোদন পেয়েছে কিনা তা আমি নিশ্চিত না। তবে আমি বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছি সিভিল এভিয়েশনের অনুমোদন পাওয়ার কথা। এছাড়া বাকী আরও যে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের কোনো অনুমোদন নেই। সিভিল এভিয়েশনের অনুমোদন না থাকলে শিক্ষার্থীদের চাকরি পেতে অনেক সমস্যা হয়। এমনকি চাকরি নাও হতে পারে।
আরটিভি: অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হলো পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম একটি আকর্ষণীয় পেশা, কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার চাকরি না পাওয়ার কারণ কী?
রেজওয়ান করিম: পৃথিবীর মধ্যে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অন্যতম আকর্ষণীয় পেশা হলেও বাংলাদেশে এ পেশার মানুষের সুযোগ কম। তবে দেশের বাহিরে এ পেশার অনেক চাহিদা। বাংলাদেশে সরকারিভাবে মাত্র একটি এয়ারলাইন্স রয়েছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বাকী দুটি হলো বেসরকারি, ইউ-এস বাংলা এবং নভোএয়ার। তবে রিজেন্ট এয়ারলাইন্স থাকলেও তার কার্যক্রম এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া অনেক আগে ছিল ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। এটি ছিল সবচেয়ে বড় প্রাইভেট এয়ারলাইন্স। এই প্রতিষ্ঠানও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের বাইরে এ পেশার প্রচুর চাহিদা। কিন্তু আমি চেয়েছি দেশের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হতে। এজন্য বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে কখনও চেষ্টা করি নাই।
এছাড়া চাকরি না পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ অভ্যন্তরীণ সীমাবন্ধতা। আমাদের দেশে যে দুটি বেসরকারি প্যাসেঞ্জার এয়ারলাইন্স বর্তমানে চালু আছে (ইউ-এস বাংলা এবং নভোএয়ার) সেখানে যারা মেইনটেন্যান্স এ চাকুরিরত আছেন তাদের সিংহবাঘ এসেছেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর। যেহেতু এইসব এয়ারলাইন্সের ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা কর্মরত আছেন, সে কারণে মেইনটেনেন্সেও বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রাধান্য পায় বেশি সিভিল থেকে। বলা বাহুল্য যে, বিমান বাহিনীতে সকল বিমানই ফাইটার এয়ারক্রাফট/ যুদ্ধবিমান অথবা কার্গো-বিমান। প্যাসেঞ্জার এয়ারক্রাফট নেই। একটি যুদ্ধবিমান এবং প্যাসেঞ্জার এয়ারক্রাফটের মেকানিজম সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুদ্ধবিমান ছোট, আর প্যাসেঞ্জার বিমান অনেক বড়। আমরা যারা অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ালেখা করেছি তারা এই বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করার পাশাপাশি লাইভ প্যাসেঞ্জার এয়ারক্রাফটে ইন্টার্নশিপ/কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সুতরাং, যুদ্ধবিমানে কাজের অভিজ্ঞতা আর প্যাসেঞ্জার বিমানে কাজের অভিজ্ঞতাও ভিন্ন। দুঃখজনক হলেও আমাদের সিভিল থেকে পড়াশুনা করে আসা যুবক ছেলে-মেয়েদের তুলনায় বিমানবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে আসা দেরকেই ম্যানেজমেন্ট বেশি প্রাধান্য দেয়।
আরটিভি: আপনি যে চাকরি পাননি এক্ষেত্রে এ পেশার প্রতি আপনার কোনো বিরূপ ধারণা হয়েছে কিনা?
রেজওয়ান করিম: পারিবারিকভাবে আমার আগেই থেকেই এ পেশার প্রতি জানাশোনা ছিল। এজন্য চাকরি না পেলেও এ পেশার প্রতি আমার কোনো বিরূপ ধারণা জন্মায়নি। তবে যারা নতুনভাবে এ পেশায় পড়ছেন, তারা হয়ত অনেক কিছু জানেন না। ফলে দেখা যায় এ পেশায় পড়েও যখন চাকরি পাচ্ছেন না, তখন তাদের মধ্যে একটা হতাশা কাজ করে এবং এ পেশার প্রতি একটা বিরূপ ধারণা চলে আসে।
আরটিভি: কীভাবে আপনার ধারনাতে ফ্রিল্যান্স করার বিষয়টি আসে?
রেজওয়ান করিম: ছোটবেলা থেকেই আমি প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী। ২০০১ সালের দিকে আমি কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে কাজ করেছি। তখনকার সময়ে অগ্নি (Agni) নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই ইন্টারনেট সেবা সরবরাহ করত। প্রতিষ্ঠানটি এখনও আছে। তখনকার সময়ে ২০০ থেকে ৩০০ মেগাবাইট কিনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম। এর ফলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন তথ্য আমার পক্ষে জানা সহজ ছিল। যখন আমি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে চাকরি পাচ্ছিলাম না, তখন এই ফ্রিল্যান্সিং এর বিষয়টি মাথায় আসে। ২০১৬ সালে গুগল এবং ইউটিউব ঘেটে ফ্রিল্যান্স করার জন্য পড়াশুনা করতে থাকি। এরপর আমি আপওয়ার্কে কাজ করার তথ্য পেয়ে যাই। এই প্লাটফর্মটি ফ্রিল্যান্সারদের জন্য একটি বিশ্বস্ত প্লাটফর্ম এবং ফ্রিল্যান্স করার ক্ষেত্রে এটি বিশ্বে এখন এক নম্বরে রয়েছে। এরপরই এখানে একটি অ্যাকাউন্ট খুলি। কোন সেক্টরে কাজ করব সেটি নিয়ে ভাবতে থাকি। আমার যেহেতু কম্পিউটার সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল এজন্য শুরুতে ডাটাএন্ট্রি এবং ওয়েব রিসার্চের কাজ শুরু করি। প্রথমে তিন মাস ধরে আমি ডাটাএন্ট্রি এবং ওয়েব রিসার্চের উপর আবেদন করে গেলাম। কিন্তু কোনো কাজ পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমি আবেদন করা চালিয়ে যেতে লাগলাম, শেষ পর্যন্ত ৭৫ ডলারের একটি অর্ডার আমি পেলাম। এরপর থেকেই বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজ পেতে থাকি। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করি। আপওয়ার্ক প্লাটফর্ম থেকেই আমি ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করি। কারণ এখান থেকে কোনো পেমেন্ট হারানোর সুযোগ থাকে না। এছাড়া রয়েছে ফাইবার। ফাইবারে অন্যতম সমস্যা হলো ফ্রিল্যান্সারদের টাকা আটকিয়ে রাখা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো ফ্রিল্যান্সার কাজ করার পর সেই কাজটি ভালো হয়নি বলে ফাইবার রিপোর্ট করে পেমেন্ট আটকিয়ে রাখতে পারে। তবে এই ধরনের সমস্যা আপওয়ার্কে নাই।
আরটিভি: ফ্রিল্যান্সিং করার শুরুতে আপনি কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?
শুরুতে তিন মাস কাজ না পাওয়ার পর আর কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। তিন বছর পুরোদমে কাজ করি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ২০১৯ সালে এসে। কাজের জন্য আবেদন করেও আবার কোনো কাজ পাচ্ছিলাম। এরকম প্রায় পাঁচ মাস পর্যন্ত কোনো কাজ পায়নি। দুঃচিন্তায় পড়ে গেলাম। পরে নিজের দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। যে কাজ এতদিন করেছি সেই কাজ অনেক পুরাতন হয়ে যাওয়ার কারণে হয়ত নতুনভাবে কোনো কাজ পাচ্ছিল না। এজন্য আমি আমার দক্ষতা আরও বৃদ্ধি করি। কোর্সসেরা থেকে ডাটা এনালাইসিস শিখে কভার লেটার আপডেট করে নতুনভাবে কাজের জন্য আবেদন করি। এরপর থেকেই কাজ পাওয়া শুরু করি। একদিন হঠাৎ করে আমার একটা অফার চলে আসে। ফিনল্যান্ডের একটি সফটওয়ার কোম্পানি আমাকে অফার করল তাদের কোম্পানিতে ডাটা এনালাইসিসের কাজ করতে। এজন্য তারা আমাকে অনলাইনে দেড় ঘণ্টা ধরে ইন্টারভিউ নিল। ইন্টারভিউতে তারা আমাকে মনোনীত করল। শুরুতে শর্ত ছিল একমাস তারা আমার কাজের ধরণ পর্যবেক্ষণ করবে। যদি সবকিছু তাদের আশানুরূপ হয়, তাহলে আমাকে তারা স্থায়ীভাবে নিয়োগ দিবে। ওই এক মাসে আমি খুব সচেতনভাবে কাজ করি। কাজে তারা সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেয় এবং প্রতিমাসে তারা আমাকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা করে বেতন দেয়।
আরটিভি: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা হলো ফ্রিল্যান্সিং করে যা শিখেছি তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। এখানে কাজ করতে গিয়ে কী ধরনের বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি তা জানানো। যারা নতুন এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় তাদেরকে ফ্রিতে প্রশিক্ষণ দিতে চাই। এজন্য অনলাইনে যুক্ত হয়ে অবসর সময়ে ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরি করে তা ছড়িয়ে দিতে চাই। তবে কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে এখনও ইউটিউব চ্যালেন খোলা হয়নি। খুব শিগগিরই কাজ শুরু করব। ইনশাল্লাহ।
আরটিভি: যারা নতুন অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
নতুন যারা এ পেশায় পড়বে তাদের জেনে বুঝে তারপর আসতে হবে। কারণ এ পেশায় পড়াশুনা করা খুবই ব্যয়বহুল। তাই পড়াশুনা শেষ করে যদি কেউ চাকরি না পায় তাহলে সেটি খুবই হতাশার। তবে দেশের বাহিরে এই পেশার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
Collected from Rtvonline