কাজ করেছেন বেসিস, বিসিসি, এটুআই, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাথে। ২০১৩ সাল থেকে বেসিসে ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট কোর্সের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, পাশাপাশি নিয়মিত ফ্রিল্যান্সিংও করছেন। ওয়েব ডিজাইনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দৈনিক ইনকিলাবের সাথে কথা হয় এই ডিজাইনারের। তাঁর সাথে আলাপচারিতায় ছিলেন নুরুল ইসলাম।
ইনকিলাব: ওয়েব ডিজাইন কী?
নাজমুন নিসাত: তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ওয়েবসাইট একটি অপরিহার্য বিষয়ের নাম আর ওয়েব ডিজাইন হলো তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও ওয়েব ডিজাইন বলতে আমরা একটি ওয়েবসাইটের বাহ্যিক অবয়ব বা অবকাঠামোর নকশাকে বুঝি। মূূলত ওয়েবসাইট বানানোর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে টার্গেটকৃত ব্যবহারকারীদের রুচি, অভ্যাস ও তাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ওয়েবসাইটের কাঠামো, ইউজার ইন্টারফেস, টেম্পলেট বানানো, নেভিগেশন, লেআউট, রঙ, লেখার ধরন, ছবি, ভিডিও, অ্যানিমেশন, আইকনসহ কী ধরনের বিষয় থাকবে, কীভাবে
থাকবে এবং ব্যবহারকারীরা কীভাবে সেটা পাবে এই সব কিছুই হলো ওয়েব ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত।
ইনকিলাব: দেশে-বিদেশে এর চাহিদা কেমন?
নাজমুন নিসাত: দ্রুতগতিতে প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে ইন্টারনেটের জগৎ। প্রতিদিনই বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা, যারা ব্যস্ত আছে একাধিক ওয়েবসাইট নিয়ে। ব্যবহারকারীর সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে ওয়েবসাইট, বাড়ছে ওয়েব ডিজাইনারের চাহিদাও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, পরবর্তী ৮ বছরে ওয়েব সংশ্লিষ্ট কাজের হার বাড়বে ২৭ শতাংশ। সফটওয়্যার ফার্ম ছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানি পার্ট টাইম বা ফুল টাইম কাজের জন্য যেমন নিয়োগ দিচ্ছে ওয়েব ডিজাইনারদের তেমনি অনেকে কাজ করিয়ে নিচ্ছে ফ্রিল্যান্সারদের দিয়ে। এছাড়াও আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার, স্ক্রিপ্টল্যান্সার, রেন্ট-এ-কোডার, ইল্যান্স, জুমলাল্যান্সার, পিপল পার আওয়ার, ফাইবারসহ প্রায় সকল মার্কেটপ্লেসগুলোতে দেশের বা দেশের বাইরের যে কোনো ওয়েবসাইট ডিজাইনের কাজ সহজেই পাওয়া যায় এবং সেই কাজটি করা যাবে ঘরে বসেই। এসব মার্কেটপ্লেসগুলো ওয়েব ডিজাইনারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ইনকিলাব: ওয়েব ডিজাইন শেখার জন্য কি ধরনের প্রাথমিক যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন?
নাজমুন নিসাত: প্রাথমিক যোগ্যতা হিসেবে আলাদা করে তেমন কোন কিছু নির্ধারণ করা হয় না, যদিও কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জানা অবশ্যই দরকার। যে কোনো সময়ে যে কেউ ওয়েব ডিজাইন শিখতে পারে। কিন্তু অর্থ উপার্জনই যদি একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে আমি বলব, ওয়েব ডিজাইনে না আসার জন্য, কারণ এটি একটি সৃজনশীল ক্ষেত্র, এখানে আপনার কল্পনা, চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটাতে হবে। এর জন্য দরকার কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং ধৈর্য। আপনি ইচ্ছা করলে মাত্র ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যেই ওয়েব ডিজাইন ভালোমতো শিখে নিয়ে কাজ শুরু করতে পারবেন।
ইনকিলাব: ওয়েব ডিজাইনে কারা ভালো করতে পারবে?
নাজমুন নিসাত: শিক্ষার বিভাগ বা বয়স এখানে গৌণ বিষয় আর সৃজনশীলতা, রুচিশীলতা হল মুখ্য। প্রযুক্তি রাতারাতি পরিবর্তন হচ্ছে কাজেই তার সাথে তাল মিলিয়ে চলা এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুরুর দিকে এইচটিএমএল আর সিএসএস জানাটাই যথেষ্ট ছিল। এখন এইচটিএমএল ও সিএসএসের ভার্সনের পরিবর্তন ছাড়াও ওয়েবসাইটের লেআউটের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রেস্পন্সিভনেস অর্থাৎ একই ওয়েবসাইট বিভিন্ন ডিভাইসে সেই ডিভাইসের উপযোগী হয়েই প্রদর্শিত হওয়া। যার জন্য এইচটিএমএল ৫ আর সিএসএস ৩-এর সাথে জানতে হবে বিভিন্ন রকম ফ্রেমওয়ার্ক। যেমন বুটস্ট্রাপ, সিএসএস লেস ফ্রেমওয়ার্ক ইত্যাদি। এছাড়া জানতে হবে ফটোশপের কাজ কেননা ওয়েব ডিজাইনারকেই তার ওয়েবসাইটের জন্য পোস্টার, ব্যানারসহ বিভিন্ন ছবি, বাটন, মেনুর কাজ করতে হয়। ভালোমানের ফ্রন্ট ডেভেলপার হতে হলে জেকুয়েরি, জাভাস্ক্রিপ্ট জানাটাও জরুরি। কাজেই যাদের এসব বিষয়ে দক্ষতা আছে, তারাই ভালো করতে পারবে। আর আপনার পড়াশোনা যদি হয় এই ধরনের কোন বিষয়ে সেটা আপনার কাজের ক্ষেত্রে যোগ করবে বাড়তি সুবিধা।
ইনকিলাব: আপনি কখন ও কীভাবে এর সাথে যুক্ত হলেন?
নাজমুন নিসাত: বিজ্ঞান, কম্পিউটার, প্রযুক্তি সবসময় আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় বিষয় ছিল। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে বিএসসি করার সময়, চতুর্থ বর্ষে আমরা কয়েকজন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে তৈরি করি একটি ওয়েবসাইট। তখন থেকেই ওয়েবসাইট নিয়ে আমার কাজ করা শুরু। এরপর বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের অধীনে ইন্টার্নশিপ করার সময় প্রথমে ওয়েব ডিজাইনার হিসেবে যোগদান করলেও পরবর্তীতে বেসিস থেকে ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপিংয়ের প্রশিক্ষণ নিই তখন থেকে ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে কাজ করতে শুরু করি।
ইনকিলাব: ক্যারিয়ার হিসেবে ওয়েব ডিজাইন কেমন?
নাজমুন নিসাত: ওয়েব ডিজাইনার খুব সম্মানজনক পেশা। বিশ্বের সেরা ২০ চাকরির তালিকায় আছে ওয়েব ডিজাইন আর একই সাথে এই পেশা স্থান করে নিয়েছে ভোকেশনাল সেক্টরে সেরা ১০ সর্বোচ্চ বেতনের চাকরির তালিকায়। এই পেশাতে কর্মক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতার মূল্য আছে। কাজেই আপনার কর্মক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আপনি পাবেন যথার্থ সম্মান, সম্মানী এবং পদোন্নতি। এছাড়া অনেকেই ওয়েব ডিজাইনের পরে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ও ডেটাবেজ শিখে ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে কাজ করতে পারে। সুতরাং একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান সময়ে সম্মানজনক এবং ভালো আয় করার মাধ্যম হচ্ছে ওয়েব ডিজাইন।
ইনকিলাব: এখানে খ-কালীন কাজের সুযোগ কতটুকু?
নাজমুন নিসাত: খ-কালীন কাজের সুযোগ এই সেক্টরে প্রচুর। আমাদের দেশে বিভিন্ন কোম্পানী আছে যারা শুধুমাত্র খ-কালীন চুক্তিতেই ওয়েব ডিজাইনারকে নিয়োগ দেয়। ওয়েব ডিজাইন যেহেতু ডেস্কভিত্তিক চাকরি নয়, কাজেই খ-কালীন চাকরির ক্ষেত্রে বাসায় বসে কাজ করাটাও এই পেশার জন্য খুবই স্বাভাবিক। আগেও বলেছি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করার জন্য এটি একটি উত্তম সেক্টর। আবার অন্য চাকরির পাশাপাশিও অনায়াসেই করা যায় ওয়েব ডিজাইনিং। নতুন ডিজাইন করা, পুরনো ডিজাইনকে পরিবর্তন করা, টেম্পলেট বানানো ছাড়াও আপনি যোগ দিতে পারেন খ-কালীন ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কোনো ওয়েব ডিজাইন কোর্সে।
ইনকিলাব: এই পেশায় আয়রোজগার কেমন হতে পারে?
নাজমুন নিসাত: পার্ট টাইম, ফুল টাইম জব অথবা ফ্রিল্যান্সিং যে কোনোভাবেই ওয়েব ডিজাইনকে পেশা হিসেবে নেয়া যায় অনায়াসেই। সাধারণত, ফুল টাইমের ক্ষেত্রে একজন ওয়েব ডিজাইনারের মাসিক বেতন শুরু হয় ২০ হাজার টাকা থেকে। অন্যদিকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যেখানে অন্য অনেক কাজের রেট ঘণ্টায় ২ ডলার, সেখানে একজন ওয়েব ডিজাইনারের রেট শুরু হয় ঘণ্টায় ১০ বা ১২ ডলার থেকে ৫০ ডলার পর্যন্ত, যদিও এটি নির্ভর করে কাজের ধরনের উপর। প্রতিনিয়ত কাজ না করেও শুধুমাত্র ওয়েব টেম্পলেট এবং ওয়েব ইলিমেন্ট খুব ভালো দামে একাধিকবার বিক্রি করা যায় বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। খ-কালীন ডিজাইনার যেমন বছরে ২০,০০০ ডলার আয় করতে পারে। অপরপক্ষে প্রতিভাবান এবং পরিশ্রমী কিছু ওয়েরসাইট ডিজাইনার বার্ষিক ১০০,০০০ ডলারের উপর আয় করতে পারেন। সবটাই নির্ভর করে তার কাজের উপর।
ইনকিলাব: কীভাবে কাজ করলে একজন সফল ওয়েব ডিজাইনার হওয়া সম্ভব?
নাজমুন নিসাত: কাজের প্রতি ভালোবাসা, সততা হল মূল চাবিকাঠি তা সে যে কাজই হোক না কেন। আর ওয়েব ডিজাইনের জন্য আমি ২টি কাজের কথা বলব। এক, এটি সৃজনশীল পেশা যা একই সাথে সহজ, কারণ নিজের ইচ্ছায় করা যায়। আবার একই সাথে কঠিন, কারণ অন্যকে নিজের কাজ দিয়ে প্রভাবিত ও সন্তুষ্ট করতে হয়। কাজেই এই কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং। নিজের রুচির উপর এককভাবে নির্ভর না করে, কাজের ধরনটা বোঝা এবং যাদের জন্য করা হবে তাদেরকে বোঝাটা জরুরি। কারণ বাচ্চাদের সাইটের জন্য যেই রঙ, ফন্ট, মেনু স্টাইল, ছবি ব্যবহার করা হবে তার থেকে প্রফেশনাল ওয়েবসাইট হবে আলাদা আবার কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য করলে তাদের ধরনটার সাথে মানানসই হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। ওয়েবসাইট যদি ভালো না হয় তাহলে ক্লাইন্টকে আকৃষ্ট করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। দুই, প্রযুক্তি পাল্টে যাচ্ছে রাতারাতি, পরিবর্তন হচ্ছে ইউজারের রুচি আর চাহিদা। ওয়েব ডিজাইন শেখা এবং কাজ পাওয়া সহজ দেখে অনেকেই এই দিকে ঝুঁকছে সেই সাথে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। তাই নতুন পরিবর্তন সম্পর্কে জানা এবং নিজের জন্যই নিজেকে ডেভেলপ করা অবশ্যই দরকার। যেমন- এখন ট্রেন্ড চলছে বড় এবং সুন্দর ইমেজ বা ভিডিও ব্যাকগ্রাউন্ড, ফ্ল্যাট ডিজাইন, নান্দনিক টাইপোগ্রাফির; এছাড়া এখন অন ক্লিক অ্যাকশন খুবই চাহিদাবহুল। যার জন্য ব্যবহার করতে হবে জেকুয়েরি, জাভাস্ক্রিপ্ট। ওয়েব ডিজাইনারকে জানতে হবে সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের র্যাংকিং কীভাবে বাড়ানো যায় এবং বিজ্ঞাপন কোথায় ও কীভাবে দিতে হবে যাতে কাজ সম্পন্ন হয়, আর জানতে হবে ডোমেইন এবং হোস্টিংয়ের ব্যাপারে। কাজেই এগুলো সম্পর্কে জানা এবং কাজ করা দরকার, যার মাধ্যমে নিজেকে আপডেটেড রাখা যাবে এবং বাকিদের থেকে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারবেন কয়েক ধাপ।
ইনকিলাব: আগ্রহীদের জন্য আপনার পরামর্শ।
নাজমুন নিসাত: ওয়েব ডিজাইন খুবই সম্ভাবনাময় একটি পেশা। বর্তমানে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের জন্য এই পেশাতে তরুণরা অনেক আগ্রহী হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ চলছে, সেখানে প্রশিক্ষণ নেয়া যেতে পারে। এছাড়াও অনলাইনে বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই প্রচুর টিওটোরিয়াল আছে যার মাধ্যমে ঘরে বসেও শিখে নিতে পারেন। শেখার পরে আপনাকে বেশ কিছু ওয়েবসাইট ডিজাইন করে রাখতে হবে নমুনা হিসেবে আর আপনি ফ্রি হোস্টিংগুলোতে নিজের তৈরি করা নমুনা ওয়েবসাইটগুলো আপলোড করে রাখতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আপনার পোর্টফলিও; ভার্চুয়াল সিভি হিসেবে কাজ করবে এটি, কাজেই নিজের দক্ষতা, প্রাপ্তি, কাজের নমুনা দিয়ে আকর্ষণীয় একটি ওয়েবসাইট ওয়েব ডিজাইনারের থাকা দরকার যা দেখে অন্য কেউ আপনাকে তার ওয়েবসাইট বানিয়ে দিতে বলবে। আগে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারী। সেই হিসেবে ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বর্তায় ওয়েব ডিজাইনারের কাছে। ধৈর্য সহকারে কাজ করে গেলে আর নিজের উপর বিশ্বাস রাখলে অবশ্যই যে কেউ একজন ভালো মানের ওয়েব ডিজাইনার হতে পারবে।
Collection From dailyinqilab