শারীরিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন উল্লাস পাল ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে (ব্যবস্থাপনা) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তার সাফল্যে বাধা হতে পারেনি।
১৯৯৪ সালে শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলায় কার্তিকপুর গ্রামে উত্তম কুমার পাল এবং আন্না রাণী পালের ঘর আলোকিত করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সাধারণ বাঙালি পরিবারে পুত্র সন্তানের জন্ম সৃষ্টিকর্তার অশেষ দান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক কন্যা সন্তান জন্মের পর পুত্র সন্তান জন্মের আনন্দের সঙ্গে বাবা উত্তম কুমার পালের কপালে দেখা গেল কিছুটা চিন্তার রেখা।
কারণ, সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের শারীরিক গঠন কিছুটা অস্বাভাবিক। দুটো হাত এবং দুটো বাঁকা পা নিয়ে জন্ম নেয় সেই সন্তান। পায়ের গঠন অস্বাভাবিক হওয়ায় ছোটকাল থেকে অন্য দশজন শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না উল্লাস পাল। কিন্তু তার বাবা-মা দমে যাওয়ার মানুষ নয়। শুরু হলো এই সন্তানকে স্বাভাবিক জীবন উপহার দেওয়ার সংগ্রাম। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসলেন। ডাক্তারগণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে অপারগ। নিয়ে যাওয়া হলো ভারতের মাদ্রাজে। চিকিৎসা হলো কিন্তু স্বাভাবিক শিশুদের মতো হলেন না উল্লাস পাল।
শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। প্রত্যয় করেন। শারীরিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন উল্লাস পালই জীবনে সফল হবে পড়াশোনা করে। পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় হাঁটতে শিখেন তিনি। বাড়ির পাশেই কার্তিকপুর পালপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ক্লাস ফাইভে ভর্তি করা হয় বাড়ি থেকে দূরবর্তী কার্তিকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলে যাওয়ার পথে অন্য বাচ্চারা তার হাঁটাচলা দেখে হাসি-তামাশা করত।
তিনি স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে খেলতে চেষ্টা করতেন কিন্তু ঐসব কঠিন খেলা যেমন- হাডুডু, গোল্লাছুট, ক্রিকেট ইত্যাদি তার দ্বারা সম্ভব হতো না। তাই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর করার কিছু থাকত না। নিজেকে একটু অন্য রকম লাগত। কারণ, সকলেই তারচেয়ে আলাদা। ছোটবেলা থেকেই নিজের মধ্যে হীনম্মন্যতা আর লজ্জাবোধ কাজ করত। সবাই কেমন যেন অন্য চোখে দখত।
পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিলেন উল্লাস পাল। ফলে, তাকে স্কুলের শিক্ষকগণ সব সময় স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এসএসসি) বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হলে পুরো এলাকায় হইচই পড়ে যায়। ২০১২ সালে নর্দান কলেজ বাংলাদেশ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা (এইচএসসি) ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ হতে আবার জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তার স্বপ্ন হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। সংকল্প করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান। ব্যবস্থাপনা বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণিতে বিবিএ এবং এমবিএ সম্পন্ন করেন।
পড়াশোনা শেষ করে শুরু করেন চাকুরির প্রস্তুতি কিন্তু বিধি বাম, প্রস্তুতির সময়ে করোনা মহামারির হানায় আঁতকে ওঠে তার প্রাণ। একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হচ্ছিল না। ৪০ তম বিসিএস পরীক্ষায় মৌখিক পরীক্ষা দিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। কিন্তু বেশিদিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ২০২৩ সালের মার্চে সিনিয়র অফিসার (প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক) হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত হন।
৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় নন-ক্যাডার হতে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিটে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর (ননটেক-ব্যবস্থাপনা) হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। অবশেষে ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় চূড়ান্ত সফলতা ধরা দেয়। তিনি সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য তিনি কখনো কোনো কোটার ব্যবহার করেননি। বর্তমানে তিনি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। এ সাফল্যে তার বাবা-মা, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অনেক খুশি।
তিন সন্তানের জননী উল্লাস পালের মা আন্না রাণী পাল বলেন, উল্লাস আমার গর্বের ধন। সেই ছোটকাল থেকে মানুষের নানা কটূক্তি সহ্য করেও আমি তাকে পরম যত্নে বড় করেছি। আজকে তার সাফল্যের জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হারুন অর রশীদ বলেন, উল্লাস শারীরিকভাবে অস্বাভাবিক হলেও প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার সাফল্যে আমরা সবাই গর্বিত।
শিক্ষা জীবনে সে অসাধারণ সফলতা অর্জন করেছে। আশা করি চাকরি জীবনেও সে সফলতা অর্জন করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহপাঠী পাভেল বলেন, উল্লাস বন্ধু হিসেবে খুবই প্রফুল্ল এবং চঞ্চল। আমাদের সার্কেলে কখনো তাকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মনে হয়নি। আমরা তার সমৃদ্ধ কর্ম জীবন কামনা করি।
উল্লাস পাল বলেন, আমি সকলকে অনুরোধ করব, সবাই যেন তাদের ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে। যারা ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড তাদের পরিবার, শিক্ষক এবং সহপাঠীদের পূর্ণ সহায়তা প্রয়োজন। শারীরিকভাবে অস্বাভাবিক বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ যাতে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে, সেজন্য সরকারকে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে।
Collected From Daily Janakantha