‘লাইটহাউজ প্রকল্প’ নামে পরিচিত নৌপরিবহন অধিদফতরের ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পের একজন দোভাষীকেই এক বছরে বেতন বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার সামি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের দোভাষী জসিম সেখকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩ জুন প্রকল্পের ভবন ও স্থাপনার খাত থেকে এই টাকা দেওয়া হয়। অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষজ্ঞসহ নৌপরিবহন সংশ্লিষ্টরা এই ব্যয়কে ‘অস্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করেছেন।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপকূল এলাকা থেকে গভীর সাগরের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে সাতটি লাইটহাউজ ও সাতটি কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় একটি ১১ তলা ভবন নির্মাণও রয়েছে। প্রকল্পটির সর্বশেষ বর্ধিত ব্যয় ৭৭৯ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়নে ধীরগতিসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তা খতিয়ে দেখতে নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালক (সদ্যবিদায়ী) কমডোর নিজামুল হক গত ১০ এপ্রিল চার সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি গঠন করেন। অধিদফতরের সদ্য সাবেক পরিচালক ও সরকারের উপসচিব বদরুল হাসান লিটনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি গত ২১ এপ্রিল মহাপরিচালকের দফতরে প্রতিবেদন দাখিল করে।
সূত্রমতে, অধিদফতরের নিরীক্ষা কমিটি নৌ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার মাধ্যমে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে। এরমধ্যে দোভাষীর বিল ছাড়াও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবু সাঈদ দেলোয়ার রহমান নিজেই গত বছরের ৩ এপ্রিল প্রশাসনিক ব্যয় খাত থেকে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৪০ টাকা নিয়েছেন। তবে এসব ব্যয় প্রকল্পের ক্যাশ রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করার তথ্য চাওয়া হলেও পিডির দফতর থেকে কমিটিকে তা দেওয়া হয়নি। এর ফলে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত নীতিমালা (পিপিআর)-২০০৮-এর ৫ ধারা লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিরীক্ষাকালে এ প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক অসঙ্গতি ধরা পড়ে। অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামে ভৌতিক বেতন ভাতা প্রদানের তথ্যও উঠে এসেছে। তবে এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দফতর এবং নৌ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দফতর থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা মেলেনি। এমনকি মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের মৌখিক নির্দেশনা সত্ত্বেও তার দফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করেননি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের সব বিল পাওয়া না গেলেও অপর্যাপ্ত বিলগুলো পর্যালোচনা করে অনেক অসঙ্গতি মিলেছে। বিলগুলো পিপিআর-২০০৮, সরকারি আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রসহ সরকারি বিধিবিধান সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত থেকে মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও জুমাইমাহ ইন্টরন্যাশনাল (জেভি) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ১৩ লাখ ১৯ হাজার ২৭৭ টাকা। গত বছরের ১৫ জুন মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট এই টাকা গ্রহণ করে। তবে নৌ মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে এই বিলটি চাওয়া হলেও কমিটিকে দেওয়া হয়নি। এমনকি কাজ সম্পন্ন হওয়ার মেজারমেন্ট বুক চেয়েও পায়নি কমিটি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আরকেএস ট্রেডার্সকে ফি, চার্জ ও কমিশন খাত থেকে আলাদাভাবে ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৬০০ টাকা ও ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫২০ টাকা এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাত থেকে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭২০ টাকা প্রদান করা হয়েছে। তবে তিনটি বিলের মধ্যে একটি পাওয়া গেলেও অপর দুটি দেওয়া হয়নি কমিটিকে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মেরামত ও সংরক্ষণ খাতের আসবাবপত্র এবং ফিটিংস ও ফিক্সার উপখাত থেকে একই দিনে (১৫ জুন, ২০২২) আলাদা দুটি টোকেনে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩২৮ টাকা দেওয়া হয়েছে। এই দরপত্র কোটেশন কমিটিতে পাট অধিদফতরের একজন সহকারী পরিচালককে রাখা হলেও নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালকের অনুমতি নেওয়া হয়নি। কিন্তু এ সংক্রান্ত চিঠিতে নৌ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ পিডিসহ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভিন্ন ঠিকানায় আলাদা কার্যালয় রয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নিরীক্ষা কমিটি নৌ মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দফতর থেকে এ প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এ পর্যন্ত ১৭ কোটি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে। এরমধ্যে অনাবাসিক ভবন খাতে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি ৫১ লাখ ৬৯ হাজার ১০০ টাকা। এ টাকার মধ্যে সামি কনস্ট্রাকশন দুটি বিলে যথাক্রমে ৩ কোটি ১১ লাখ ৪২ হাজার ৮০২ এবং ২ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু কাজ সম্পন্নের ফিল্ডবুকের (সাইটবুক) কপি কমিটিকে দেওয়া হয়নি। অবশিষ্ট টাকা দেওয়া হয়েছে সিডিডিএল এবং স্পিডি গ্রুপ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে।
সূত্রমতে, পেশাগত সেবা, সম্মানী ও বিশেষ হার খাতের কনসালট্যান্সি উপখাত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইন, বেটস কনসালট্যান্ট এবং পাল্স কনসালট্যান্ট- তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ৬৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪০০ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইনের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে নকশায় নৌ অধিদফতরের অনুমোদনের শর্ত থাকলেও অনুমোদন নেওয়ার কোনও প্রমাণ পায়নি কমিটি। এছাড়া বেট্স কনসালট্যান্টকে নিয়োগের ক্ষেত্রে পিপিআর-২০০৮-এর ১১০ ধারার ১-৬ উপধারা মানা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাল্স কনসালট্যান্টের বিলে সাইটবুকের তথ্য পায়নি কমিটি।
এছাড়া চলতি বছরের ১৯ মার্চ অনাবাসিক ভবন খাত থেকে স্পিডি গ্রুপকে পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯১ টাকা। এসব টেন্ডার ইজিপিতে করার কথা থাকলেও বিলে তা করা হয়নি। আজকের প্রভাত ও দ্য ডেইলি আর্থ নামের দুটি অখ্যাত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় এ সংক্রান্ত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সূত্রমতে, প্রকল্পের টাকা থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত আনোয়ার শিকদার ও মো. আনছার আলী নামে দুজন গাড়িচালকের নামে বেতন বিল উত্তোলন হচ্ছে। তবে বাস্তবে মো. আনছার আলী নামে কোনও চালকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞসহ নৌপরিবহন সংশ্লিষ্টরা এসব ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল বলেন, একটি ছোট প্রকল্পে বাংলাদেশি একজন দোভাষীর মাসিক বেতন ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫০ টাকা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুধু কালক্ষেপণই হচ্ছে না, প্রতিটি পর্যায়ে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির স্বার্থে পিডি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সহ-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান প্রকৌশলী ইনামুল হক।
এ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, পুরো প্রকল্পের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা অবগত রয়েছেন। যারা দোষী তারা অবশ্যই শাস্তি পাবেন। প্রকল্পে কোনও অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তি
Collected From Banglatribune