Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার ও শাখা ক্যাম্পাস খোলার তোড়জোড়

দেশে শিক্ষার্থী না বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় বেড়ে চলেছে। এরমধ্যে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাখা’, ‘উপশাখা’ ও ‘স্টাডি সেন্টার’। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে ‘শাখা ক্যাম্পাস’ পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর মালয়েশিয়ায় কার্যক্রম চালানো চীনের অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে অনুমোদন দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের চূড়ান্ত অবস্থায় নেওয়া হচ্ছে। এতে নতুন প্রজন্মের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংকট দেখা দেবে, আর দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়বে। যদিও এখন পর্যন্ত বিদেশি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়নি ইউজিসি।


এই পরিস্থিতিতে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা বিদেশি ‘কথিত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালুর তৎপরতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ৮ থেকে ১০টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত আসনে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী পাচ্ছেন না। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সংকটে পড়ছে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন—প্রতিযোগিতায় না টিকলে নতুন প্রজন্মের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসনও ফাঁকা থাকবে। 


বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে থেকে জানা গেছে, চীনের ‘জিয়ামিন’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে মালয়েশিয়ায়। এখন মালয়েশিয়া থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের ‘উপশাখা’ (সাব-ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার) ক্যাম্পাস বাংলাদেশে চালু করার তোড়জোড় চালাচ্ছে একটি মহল। এর আগে মালয়েশিয়ার ‘ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি’কে বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের আরও ৮ থেকে ১০টি ‘অখ্যাত’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বা উপশাখা ক্যাম্পাসের কার্যক্রম দেশে চালু করার তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্প্রতি দেশে নানা রকম প্রচারণাও শুরু হয়েছে।

দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালু করতে চান—এমন একজন উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মুখ (ব্যক্তিবিশেষ) দেখে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয় ২০০টির মধ্যে রয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। অথচ অখ্যাত ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে। এতে অদক্ষ জনবল তৈরির পাশাপাশি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হবে। উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ হবে না।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘আমরা এর বিরোধিতা করে আসছি। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়নি ইউজিসি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেই তো হবে না। শিক্ষার এই বাণিজ্যিকীকরণ ঠেকাতে আমরা আগেও মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে আবেদন করেছি।’

এর আগে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজন না থাকলেও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার করা হচ্ছে। অনেক আগেই ইউজিসি স্টাডি সেন্টার পরিদর্শন করে বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু এখন দেখছি একটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়। অথচ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা এনে এ দেশে চালাতে কোনও কিছুই লাগে না। একটা রুমের মধ্যে চালালেই হয়। স্টাডি সেন্টার লাভজনক প্রতিষ্ঠান, তারা ব্যবসা করবে, বিদেশে টাকা চলে যাবে। এসব বিষয়ে আমরা সমিতি থেকে সরকারের কাছে লিখিত আপত্তি জানিয়েছি। দরকার না থাকার পরও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা খোলা একটি দুরভিসন্ধি। এতে উচ্চশিক্ষার সীমাহীন ক্ষতি হয়ে যাবে। সার্টিফিকেট বাণিজ্য হবে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদি আমাদের উচ্চশিক্ষায় এতই দৈন্য দেখা দেয়, তাহলে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নামে শাখা ক্যাম্পাস খোলা যেতে পারে। তাহলে একটি কমপেয়ার করা যাবে। তা যদি না করা হয়, তাহলে দেশের উচ্চশিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। স্টাডি সেন্টার অনেকটা কোচিং সেন্টারের মতো, এটি আমাদের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।’

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টারে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর।

জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদেশি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় যদি আসে, তাহলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। যদি তারা তাদের মান বজায় রাখে, তাহলে উচ্চশিক্ষার মান বাড়বে। পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যারা ভালো করবে, তারা চলবে, টিকে থাকবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যারা ভালো করবে না, তারাও শিক্ষার্থী পাবে না।’ 

অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে দেশে অবৈধভাবে নানা নামে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। উচ্চশিক্ষার বিকাশের নামে প্রতারণা, সনদ বিক্রি, ইচ্ছেমতো উপশাখা ক্যাম্পাস ভাড়া দেওয়া ও আদমপাচারের ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরনের অভিযোগে ২০০৭ সালে সরকার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী ৫৬টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এরপর দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, শাখা, স্টাডি সেন্টার এবং কেউ কেউ বিদেশি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।

মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মোনাশ কলেজের স্টাডি সেন্টার খোলার অনুমতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।  আইনে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস খোলার কথা বলা আছে। স্টাডি সেন্টার খোলার কথা বলা নেই। তবে ২০১৪ সালের বিধিমালায় স্টাডি সেন্টার পরিচালনার কথা বলা আছে।  বিধিমালা অনুযায়ী, স্টাডি সেন্টারে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। এটির আলোকেই ইতোমধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়েছে। যদিও এই নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কয়েক বছর ধরে ওই বিধিমালা সংশোধন করার প্রক্রিয়া চলছে। এরমধ্যেই মালয়েশিয়ার ‘ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির’ স্টাডি সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গত ২ মার্চ  এটির কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছে। এর আগে দেশে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘মোনাশ কলেজ (অস্ট্রেলিয়া)’ স্টাডি সেন্টারের কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেওয়া হয়।

ইউজিসি সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের দিকে দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৫৫ থেকে ৫৬টি। বর্তমানে সেই সংখ্যা ১০৮টি। একই সঙ্গে বাড়ছে সরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া সরকার প্রতি জেলায় অন্তত একটি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের দাবি, যেসব শর্তে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো কোচিং সেন্টারনির্ভর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে শিক্ষা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, উচ্চশিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যমান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্টাডি সেন্টারগুলো সরকারকে ট্যাক্স, ভ্যাট দিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এর ফলে এগুলো বাণিজ্যনির্ভর প্রতিষ্ঠানেই পরিণত হবে।

উচ্চশিক্ষায় বাড়ছে না শিক্ষার্থী

২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে। এ পরীক্ষায় মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এসব শিক্ষার্থী এখন অনার্স (সম্মান) ও সমস্তরে ভর্তি হবে। জানা গেছে, স্নাতক, ডিগ্রি পাস কোর্স ও অন্যান্য স্তরে আসন রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ। সেই হিসাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত চার লাখ আসন ফাঁকা থাকতে পারে। কোভিড মহামারিতে বিশেষ মূল্যায়নে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন পরীক্ষার্থীর সবাইকে পাস দেওয়া হয়। এরপর ২০২১ সালে এই স্তরে ১৩ লাখ ৬ হাজার ৬৮১ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হয় ২০২২ সালে।

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ৯ লাখের মতো, যা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর প্রায় ৬৫ শতাংশ। তাছাড়া ২০২২ সালে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজারের বেশি আসন ফাঁকা ছিল।
Collected from Banglatribune