Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
হাঁটুতে ভর করে স্নাতক পাস, অমৃতা চায় একটি সরকারি চাকরি

জন্ম থেকেই দুটি পা নেই তার। তবুও তিনি হাঁটছেন জীবনের পথে। শত বাধা পেরিয়ে তিনি এগিয়েই চলেছেন বিজয়ীর বেশে। বরগুনার এক অদম্য নারী অমৃতা-বালার জীবনের গল্প এটি। চোখে আঙুল দিয়ে যিনি দেখিয়ে দিয়েছেন মনোবলই বড় বল। ইচ্ছে শক্তিই বড় শক্তি।

অভাব-অনটন আর নিদারুণ দারিদ্র্যের মাঝে জন্ম তার। জন্মের পরপরই নিরুদ্দেশ বাবা। কোথায় আছেন কেমন আছেন জানা নেই কারও। দেনার দায়ে বন্ধক রাখতে হয়েছে পৈতৃক ভিটেটুকুও।

অবজ্ঞা অবহেলা আর শত বঞ্চনার মাঝেই তার বেড়ে ওঠা। তবুও হাল ছাড়েননি তিনি। হামাগুড়ি দিয়েই এগিয়ে চলেছে তার শিক্ষা জীবন। কৈশোরে দুই মাইল দূরের গ্রাম থেকে নিয়মিত স্কুলে আসতেন তিনি। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে এখন তিনি স্নাতক। চলছে স্নাতকোত্তর লেখাপড়া। একই সঙ্গে চলছে জীবন সংসারও।

বরগুনার পুরাঘাটা গ্রামের গণেশ বালা ও বিভা রাণীর মেজো সন্তান অমৃতা বালা (২৮)। জন্মের পর প্রতিবন্ধী সন্তানের মুখ দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয় বাবা। পরম যতনে আঁচলে আগলে রাখেন মা। বড় আদর করে মেয়ের নাম রাখেন অমৃতা বালা।

নামে অমৃতা বালা হলেও বড় তিক্ততায় ভরা জীবন তার। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অংশ নিতে পারেননি শৈশব কৈশোরের কোনো খেলাধুলায়। আম কুড়ানোর স্মৃতি নেই তার জীবনে। খুব একটা মেলেনি বন্ধু-বান্ধবও। অবজ্ঞা আর অবহেলাই যেন তার নিত্যসঙ্গী।

জীবিকার তাগিদে ভাই আশীষ বালা সংসার পেতেছেন বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। টানা পোড়নের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তার। ছোট বোন মালোশি কর্মকারের বিয়ে হলেও বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয়নি অমৃতার।

অমৃতার মা বিভা রানী বলেন, ‘অমৃতার বাপে (বাবা) কুম্মে থাহে হে মোরা জানি না, দুই বুইনেরে ল্যাদা থুইয়া কুম্মে যে গ্যাছে আর কোনো খোঁজ খবর নাই। তয় আট বছর আগে ছোট মাইয়ার বিয়ার কালে একফির আইছেলে পরে আবার চইল্লা গ্যাছে। এই মাইয়ারে লইয়া আমি অনেক কষ্ট করছি জীবনে, মাইনসের বাসায় কাম হইরা, বদলা দিয়া, মাডি কাইট্টা, অনেক কষ্টে মানুষ করছি মাইয়াডারে। কত যে না খাইয়া দিন কাডাইছি আমরা’।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে হামাগুড়ি দিয়ে নিজেই ক্লাসে গেলেও বৃষ্টির মৌসুমে কখনোই ক্লাস করতে পারেনি অমৃতা। উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ি থেকে দূরে হওয়ায় যেতে হতো রিকশা বা ভ্যানে। আর্থিক দৈন্যতার কারণে সব সময় যাতায়াত ভাড়া না থাকায় নিয়মিত ক্লাসেও যেতে পারত না অমৃতা। মেয়ের ইচ্ছা সরকারি চাকরি করার, তাই সরকারের প্রতি তার আকুল আবেদন যেন তার মেয়েকে একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়’।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পৈতৃক সম্পত্তির মধ্যে বসবাসের জন্য ছোট্ট একটি যৌথ মালিকানার জীর্ণ ভাঙা ঘর আর ২০ শতাংশ জমি (বর্তমানে বন্ধক রয়েছে) ছাড়া আর কিছুই নেই। আসবাবপত্রের মধ্যে একটা পড়ার টেবিল, দুটি চেয়ার, একটা মাটির গোলা আর দুটো পুরোনো চৌকি। এর মধ্যেই চলছে দুটি প্রাণের নীরব বসবাস।

অতি অল্প বয়সে শত প্রতিকূলতার মাঝেও সংসারের হাল ধরেছেন অমৃতা। এত অভাব-অনটন আর টানাপোড়নের মাঝেও বিধাতা কিংবা ভাগ্যকে দোষারোপ করে থেমে থাকেননি তিনি। পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন নিজ প্রচেষ্টায়।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় নিয়েছেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। পড়াশুনার পাশাপাশি টিউশনি করে দুই বেলা অন্ন জোগাড় হয় তাদের। গাড়ি ভাড়া আর টিউশনির টাকা জমিয়ে ১১ হাজার টাকায় কেনেন একটি দুধের গাভি। সেখান থেকেই ৪টি গরুর ছোট্ট একটি খামার। এভাবেই এগিয়ে চলেছে অমৃতার সংগ্রামী জীবন।

অমৃতা বলেন, আমি আমার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চাই এবং সমাজের বোঝা হয়ে বাঁচতে চাই না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি স্নাতকোত্তর শেষ করব এবং পাশাপাশি সরকারি অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করব।

অমৃতার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. শামছুল আলম বলেন, আমার শিক্ষকতা জীবনে অমৃতার মতো পরিশ্রমী আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির মানুষ দ্বিতীয়টি দেখিনি। অমৃতা দুই হাঁটুতে ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে দুই মাইল পথ অতিক্রম করে স্কুলে এসে ক্লাস করত। পরে উচ্চমাধ্যমিক এবং ডিগ্রি পাস করেছে। আমরা যথাসম্ভব তাকে সহায়তা করেছি।

তিনি আরও বলেন, অমৃতা বড় হয়েছে। সংসারের প্রতি দায়িত্বও বেড়েছে। তাই সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি অমৃতাকে যেন একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
Collected From Rtvonline