সে প্রতিবেদন এমনটাই বলে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যেন বেকারত্বে কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই প্রতিবেদনে আশ্চার্য কিছু তথ্য উঠে আসে। যা আমাদের উচ্চশিক্ষিতদের জন্য অশনিসংকেত। সে প্রতিবেদনে ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে কিছু তথ্য দেওয়া হয়। তাতে ¯œাতক ও ¯œাতক পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকরত্বে একটা চিত্র উঠে আসে। প্রতিবেদনে ¯œাতক ও ¯œাতক পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বে হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ বলে প্রকাশ করা হয়।
২০১০ সালেও এই হার ছিল মাত্র ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। কয়েক বছরে বেকারত্বে হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়, এটা উচ্চশিক্ষিতদের জন্য বড় দুঃখজনক। যদি এসএসসি বা এইচএসসি পাস শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বে হার বেশি থাকতো বা বৃদ্ধি পেত তাহলে বলা হতো যে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম তাই চাকরি পাচ্ছে না। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই কথা ধোপে টিকে না। এসএসসি বা এইচএসসি পাসদের মধ্যে বেকার উচ্চশিক্ষিতদের চেয়ে আরো কম। এখন প্রশ্ন হলো কেন তাদের মধ্যে এই বেকারত্ব? তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা তো কম না। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের বেশ কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট আন্তরিক তারা স্টাডি করতে পিছিয়ে নেই। তবে বলতে বাধ্য যে, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট পিছিয়ে।
শিক্ষার সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশের নিবিড়। শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী পরিবেশ। পরিবেশ কথাটা ব্যাপক, এর সাথে শিক্ষাঙ্গনের সব কিছুই জড়িত যেমন : শিক্ষাঙ্গনের রাজনৈতিক পরিবেশ, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ইত্যাদি। আরেকটা বিষয় হলো মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা দেশ ও জাতির উন্নয়নের সোপান। তেমনি মানসম্পন্ন শিক্ষা ছাড়া সে উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এখন কথা হচ্ছে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে কতটা উপযোগী? এবং কতটা অনুকূল আমাদের শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ? আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিবো কোথায়।’ অসুস্থ রাজনীতির ছোঁয়ায় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক পরিবেশ এতটাই অসুস্থ যে, শিক্ষার উদ্দেশ্যে রাজনীতি তা সেই উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে এখন শিক্ষার উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের পরিবেশকে চরমভাবে বিঘিœত করছে। রাজনীতির নামে সহিংসতার কারণে প্রায়ই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হচ্ছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা সবার জানা। গত বছরের শেষ দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র নেতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। গত ২০১৪ সালে এক শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে ৪ মাস। প্রায় সকল উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর অবস্থা এই রকম। বন্ধ থাকার ফলে সাধারণভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত থাকে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সেশনজটের। থেমে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও শিক্ষার গতি। অন্যদিকে মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব তো আছেই। শ্রেণিকক্ষ সংকট, আবাসন সংকট, শিক্ষক সংকট, সেমিনার ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব, গবেষণাগার ও কম্পিউটার ল্যাব না থাকা, সেশনজট, যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চাকরির বাজারে সার্টিফিকেটের জোরে আর টিকতে পারছে না আমাদের উচ্চশিক্ষিতরা। এ কারণেই উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব থাকলে মানসম্পন্ন শিক্ষা কী করে নিশ্চিত করা যায়? একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় বাদে দেশের সব কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ আবাসন ব্যবস্থা নেই। এমন কী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আবাসন ব্যবস্থাই নেই। প্রায় সব কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার লাইব্রেরিগুলোতে প্রয়োজনীয় বই নেই। আধুনিক গবেষণাগার নেই বললেই চলে, নেই কম্পিউটার ল্যাব। শিক্ষক সংকট, আর শ্রেণিকক্ষ সংকট তো আছেই। কী করে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হতে পারে? অপরদিকে শিক্ষা ব্যবস্থা রয়ে গেছে যুগের অনেক পিছনে। একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়–য়া শিক্ষার্থীর জন্য নেই আধুনিক ইন্টার্নির ব্যবস্থা। মেডিকেলে পড়া শেষ করে মুখস্ত করতে হয় রবীন্দ্রনাথ কতটা কাব্য রচনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম কত সালে। তাহলে চরম নীতিবিরোধী শিক্ষা ব্যবস্থা কী করে বেকারত্বের হার কমাবে? একাডেমিক পড়ায় সময় বেশি দিলে চাকরির প্রস্তুতি হয় না আবার চাকরির প্রস্তুতি নিলে একাডেমিক পড়া হয় না। এ যেন উভয় সংকট। শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়? একাডেমিক রেজাল্ট ভালো করে চাকরি পাওয়া যায় না কারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মিল রেখে কর্মসংস্থান নেই বা করা হয়নি। চাকরির বাজারের পড়া বাংলা, ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞান দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আবার বাংলা, ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞান পড়ে চাকরি করতে হচ্ছে। ৫ বছর একাডেমিক পড়া শেষ করে আবার চাকরির পড়া পড়তে গিয়ে বয়স শেষ। বেকার তো হবেই।
‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এত বাধা পিছনে ফেলে এসে চাকরির বাজারে এখানে আবার কোটার জাল পাতানো আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ কোটার দখলে। অন্যদিকে বিসিএসে ৫৫ শতাংশ নিয়োগ দেওয়া হয় কোটা থেকে। প্রতি বছর হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত মেধাবী তরুণ বেকার হচ্ছে কোটার কারণে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি, নারী, পোষ্য, জেলা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (উপজাতি), খেলোয়াড় ও প্রতিবন্ধীসহ নানা ধরনের কোটা রয়েছে। মেধার ভিত্তিতে চাকরি নয়, কোটার চাকরি হয়ে গেছে। কোটার বাধা পার হতে পারলেও আবার মামা-খালু, চাচা না থাকায় অনেক মেধাবী ভাইভা বোর্ড থেকে অদৃশ্য বেকারত্বে সার্টিফিকেটধারী হয়ে বের হচ্ছে। গরিব মেধাবী উচ্চশিক্ষিতরা টাকার অভাবে চাকরির বাজার থেকে সহজেই বিদায় নিচ্ছে। দুর্নীতির অবস্থা এমন হয়েছে যে এটা যেন নিয়ম হয়ে গেছে যে, টাকা ছাড়া বা লোক ছাড়া চাকরি হবে না। তাই যদি হয় তাহলে পড়ে আর লাভ কি?
কর্মসংস্থানের হ্রাস বেকারত্বে জন্য আরেক বিপদ। যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের রয়েছে পর্যাপ্ত অভাব। ‘অভাগা যে দিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়’ অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৪ জানুয়ারি অপর একটি জাতীয় দৈনিকে “জোটভুক্ত ক্রেতা সংগঠন ‘অ্যাকর্ড’-এর শর্তারোপ টঙ্গীতে একরে পর এক বন্ধ পোশাক কারখানা” শিরোনামে একাটা খবর প্রকাশ হয়। ইতোমধ্যে জোটভুক্ত ক্রেতা সংগঠন অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশের বেঁধে দেয়া শর্ত পূরণ না করতে পেরে টঙ্গীতে ৩০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি হারিয়ে লাখো শ্রমিক দিশেহারা। এমনভাবে কর্মসংস্থান বন্ধ হওয়া মানে ‘মহা বেকারত্ব বৃদ্ধির পদধ্বনি’ ঠিক এই শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত ২২ জানুয়ারি অন্য একটি দৈনিক পত্রিকার ১ম পৃষ্ঠায়। বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধি ১৫ শতাংশ, গ্যাস খরচ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশ এবং গত দুই বছরে শ্রমিক খরচ ৩২ শতাংশ বেড়েছে। সব মিলিয়ে ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে বিনিয়োগকারীদের। তাই বিনিয়োগ গুছিয়ে নিচ্ছে তারা। শত প্রতিকূল পরিবেশের কারণে কমে যাচ্ছে কর্মসংস্থান। যখন কর্মসংস্থান থাকবে না বেকার তো হতেই হবে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চরম অবহেলা সরকারি-বেসরকারি দু’ভাবেই রয়েছে। সরকার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আন্তরিক হলেও কর্মে আছে যথেষ্ট আন্তরিকতার অভাব। ফলে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব কমাতে পারেছে না বরং উল্টো বেড়ে চলছে।
এখন কথা হলো বেকার সমস্যা দূর করতে হলে বেকার যেসব কারণে হচ্ছে সেসব কারণ তো দূর করতে হবে। সমস্যা যে জাগায় সমাধান সে স্থান থেকেই শুরু করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে করতে হবে যুগোপযোগী, মানসম্পন্ন এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষার উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। সাবধান থাকতে হবে অসুস্থ রাজনীতির ছোঁয়া যেন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না লাগে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য মূলক কোটার সমস্যা সমাধান করতে হবে। এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।
ষ লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Collected From dailyinqilab