কথাটি কিন্তু একেবারে অযৌক্তিক নয়।
হ্যাঁ এটি সত্য যে, শিক্ষিত হওয়া কিংবা উচ্চশিক্ষিত হওয়া মানে বিশেষ কিছু দক্ষতা অর্জন করা (মানবিক তো বটেই) যা দ্বারা তারা দেশি, বিদেশি কোনো সংস্থায় সার্ভিস দিয়ে অর্থ উপার্জন করা, যা দ্বারা নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করা হয়। জয় আরও বলেছেন, দেশে বিসিএসে মাত্র কয়েক হাজার পোস্ট অথচ প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স পাস করা শিক্ষার্থী বের হন, সবাই যদি সরকারি চাকরি খোঁজেন তাহলে জায়গা কোথায়? আসলেই ঠিক কথা।
আবার এটিও দেশে ঘটছে যে, হাজার হাজার বিদেশি তরুণ ও যুবক বাংলাদেশে কাজ করে তাদের নিজের দেশে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছে। এর শীর্ষে রয়েছে ভারত। তার অর্থ হচ্ছে- আমাদের দেশে যারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন, তারা সে ধরনের দক্ষতা অর্জন করছেন না। ফলে বিভিন্ন কর্পোরেট সেক্টর ও বেসরকারি সংস্থাকে বিদেশ থেকে লোক আনতে হচ্ছে। এখানেও চিন্তা করার বিষয় আছে। বিষয়টি কি আসলেই তাই?
নাকি এটি একটি ফ্যাশন যে, আমাদের অফিসে বিদেশি আছে কিংবা রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে আমাদের অফিসে বিদেশি রাখা হচ্ছে। আমাদের দেশের তরুণরা বিদেশে গিয়ে প্রচুর সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন অথচ দেশে তাদের মূল্য নেই, এটি কী করে হয়? দক্ষতায় যে ঘাটতি রয়েছে, সেটি করার জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এবং দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন আনতে হবে, তা ভাবতে হবে গভীরভাবে।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেলেও দেশে ভালো চাকরির নিশ্চয়তা নেই। উচ্চশিক্ষায় দুর্দান্ত ফল অর্জনকারীদের মধ্যে ২ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ বেকার। আবার যারা চাকরি পান, তাদের ৭৫ শতাংশেরই বেতন চল্লিশ হাজার টাকার নিচে।
উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের চাকরি, বেতন ও বেকারত্বের এ হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণায়। ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শিক্ষিতদের (এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী) এক-তৃতীয়াংশই বেকার। তাদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার বেশি অর্থাৎ যাদের পেছনে দেশ ও পরিবার বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, তারাই বেশি বেকার। এ কেমন কথা?
মেধাবীদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। কি এর কারণ? বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ।
এদিকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া প্রতি তিনজনের একজনই বেকার বসে আছেন। আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ-৫ পাওয়াদের মধ্যে ৩১ শতাংশের বেশি বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, কাজপ্রত্যাশীদের মধ্যে সপ্তাহে ন্যূনতম এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজের সুযোগ না পেলে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশে এমন বেকার ২৭ লাখ। বিআইডিএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি পেয়েও চাকরি মেলে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘হতাশার বিষয় হল মাস্টার্স পাস করেও দশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি না পাওয়া। পছন্দমতো চাকরি তারা পাচ্ছে না কিংবা বাজারে যে ধরনের চাকরি আছে, সেই ধরনের ডিগ্রি তাদের নেই। এতে সমাজ ও সরকার যে বিনিয়োগ করল, সেটা কাজে লাগল না।এভাবেই শিক্ষিত শ্রমশক্তির অপচয় হচ্ছে।’
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী চাকরিজীবীদের মধ্যে মাত্র ২৫ দশমিক ৪৯ শতাংশের বেতন চল্লিশ হাজার টাকার বেশি। এমন মেধাবীদের মধ্যে আবার দশ শতাংশ মাসে দশ হাজার টাকাও বেতন পান না। বাকি ৬৫ শতাংশ মেধাবীর বেতন দশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার মধ্যে। স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়েছেন, এমন তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বেতন দশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকার মধ্যে।
স্নাতকে প্রথম শ্রেণি পাওয়া ২৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ডিগ্রিধারী চল্লিশ হাজার টাকার বেশি বেতন পান। এ ধরনের ৭০ শতাংশ মেধাবীর বেতন দশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার মধ্যে। আর ৫ শতাংশ তো মাস শেষে দশ হাজার টাকাও পান না। স্নাতক পর্যায়ে সিজিপিএ পদ্ধতিতে সাড়ে তিন শতাংশের বেশি স্কোরধারীদের প্রায় ৩৯ শতাংশের বেতন চল্লিশ হাজার টাকার বেশি। সিজিপিএ সাড়ে তিনের বেশি স্কোর করা ৪৫ শতাংশ স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতন পান।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, শিক্ষাজীবনের প্রথম শ্রেণি বা ভালো রেজাল্ট চাকরির বাজারে বেতন বেশি পাওয়ার জন্য একমাত্র নিয়ামক নয়, তবে চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণি পাওয়া মেধাবীরা এগিয়ে থাকেন। কিন্তু চাকরিতে তিনি কেমন করছেন, কতটা দক্ষ হয়েছেন- সেটাই পরবর্তী সময়ে বেতন-বৃদ্ধির নিয়ামক হয়ে যায়। তিনি অবশ্য বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রথম শ্রেণি পাওয়া মেধাবীরা বেশি বেতনের চাকরি পাবেন এবং তাতে সফল হওয়ার ব্যাপারে খুব আশাবাদী থাকেন। কিন্তু পরে বাস্তবতার সামনে পড়ে তারা হতাশ হন।
গবেষণায় দেখা যায়, মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। এদের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক এবং ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত বেকার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
শিক্ষিতদের মধ্যে নিু মাধ্যমিক পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ। শঙ্কার বিষয়, গবেষণায় চাকরিরতদের প্রসঙ্গে বলা হয়; বেতন পান এমন সার্বক্ষণিক কাজে নিয়োজিত ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ। পূর্ণকালীন আত্মকর্মসংস্থানে আছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। খণ্ডকালীন বেতনভিত্তিক কাজে নিয়োজিত ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। খণ্ডকালীন আত্মকর্মসংস্থানে আছে ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
কর্মসংস্থানে গ্রাম-শহর পার্থক্যটা বেশ স্পষ্ট। বেতনভিত্তিক চাকরিতে গ্রামের তুলনায় শহরে কাজের সুযোগ বেশি। এর মধ্যে মেট্রোপলিটন শহর এগিয়ে আছে, এটি স্বাভাবিক। তবে আত্মকর্মসংস্থানে শহরের তুলনায় গ্রাম এগিয়ে। জরিপে দেখা যায়, শিক্ষা শেষে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত বেকার ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। দুই বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে বেকার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ। ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেকার ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
ছয় মাসের কম সময় ধরে বেকার ৫০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ গবেষণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হয়েছে। জাতীয় যুবনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের ৬ লাখ ১৮ হাজার ২৬২ জন তরুণ-তরুণীকে ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে গবেষণার প্রশ্ন পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে ১৫ হাজার ২৫ জন উত্তর পাঠিয়েছেন। তাদের উত্তরের ভিত্তিতেই গবেষণাটি করা হয়েছে। তারা সবাই স্নাতকোত্তর, স্নাতক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পাস।
আর একটি জরিপে অংশ নিয়েছেন আট হাজার ৭৭১ তরুণ-তরুণী। এর মধ্যে বেকারের সংখ্যা দুই হাজার ৯১১ জন, যার মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৮৮৯ জন। পুরুষদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩১ দশমিক ১ শতাংশ। নারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ। শিক্ষিত যুবকদের প্রসঙ্গে এতে বলা হয়, পূর্ণকালীন বেতনভিত্তিক কর্মসংস্থান সর্বোচ্চ শিক্ষা পর্যায়ের ওপরের দিকেই বেশি।
এর মধ্যে মাস্টার্স পর্যায়ের হার সবচেয়ে বেশি ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। স্নাতকে এই হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এইচএসসিতে আবার এসএসসির তুলনায় কিছুটা কম। এইচএসসি পর্যায়ে পূর্ণকালীন বেতনভিত্তিক কর্মসংস্থান ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এসএসসি পর্যায়ে এই হার ৩৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বেতনের পরিমাণও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হযেছে। গবেষণায় দেখা যায়, পূর্ণকালীন বেতনভিত্তিক কর্মসংস্থানের মধ্যে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন এসএসসি পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ৪৪ শতাংশ। মাস্টার্স পর্যায়ে সবচেয়ে কম ২১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
উপরোক্ত দুটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানেও অন্যদের তুলনায় উচ্চশিক্ষিতরা তুলনামূলক বেশি বেতন পান। আবার তাদের মধ্যে বেকারও বেশি। চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার ভালো সমন্বয় হচ্ছে না। শিক্ষিতদের বড় একটা অংশ যদি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে, তাহলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিষয়টি নিয়ে ভাবনা চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারেও যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
Collection From jugantor