Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
দেশে বেকারত্বের অবসানে দরকার প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান

সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষিত বেকার। দেশের সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের জোগানদাতা বেসরকারি খাত। অথচ এই খাতের অবস্থা বিগত করোনাকালীন বছর দুই ধরেই ভালো যাচ্ছে না। বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো না থাকার কারণে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না, বরং অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। এর ফলে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। উচ্চশিক্ষিতরা বেকার হওয়ার কারণে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। নতুন করে চাকরি হারাচ্ছেন অনেকেই। পড়াশোনা করার পরও শিক্ষিত যুবকদের কর্ম না থাকায় তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। করোনার সময়ে বিশ্বের অর্ধেক তরুণ-তরুণী উদ্বেগ ও হতাশায় আক্রান্ত। করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই ভুগছেন মানসিক সমস্যায়। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন অথবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ঘরবন্দি থাকার কারণে বাড়ছে পারিবারিক কলহ-বিবাদ, এতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে। ফলে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। যদি এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায় তা হলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে উন্নয়নের পথে বড় বাধা হলো বেকারত্ব।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭.৩৯%)। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই বেকারত্ব বাড়ছে। বেকারত্বের হারের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। সরকারি চাকরিতে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮। করোনার কারণে ৬ মাস ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের নিয়োগ স্থগিত থাকায় এ সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। এসব পদে নিয়োগ পেতে অপেক্ষায় আছেন ৩০ লাখের বেশি শিক্ষিত বেকার। করোনার প্রভাবে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে চাকরি হারিয়েছেন অনেকেই। দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরির জন্য লড়াই করতে হয় লাখ লাখ তরুণকে। অনেক শিক্ষিত গ্রাজুয়েটকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়। এর মধ্যে প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণী। নন-ক্যাডার সরকারি ও বেসরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেন আরও বেশিসংখ্যক পরীক্ষার্থী। করোনা পরিস্থিতির কারণে সব চাকরির পরীক্ষাই স্থবির হয়ে গেছে।
লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তাতে বিশে^ ৩৩০ কোটি কর্মক্ষম মানুষ আংশিক বা পুরোপুরি বেকার হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সংকট আর আসেনি। একটি দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে সে দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা। বিশেষ করে দেশের বেকারত্বের হার ও দারিদ্র্যের প্রবৃদ্ধি অন্যতম। পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশই প্রতি মাসে বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর হার প্রকাশ করে থাকে। করোনা মহামারির প্রভাবে গত দুই বছরে বহু মানুষ বেকার হয়ে কেউ পেশা পরিবর্তন করেছে, কেউ আর কাজে ফিরতে পারেনি। ফলে শহর ও গ্রামে দারিদ্র্য বেড়েছে। করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, কর্মসংস্থানের মূল ক্ষেত্র হচ্ছে বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য ক্ষেত্র গড়ে তোলা হয়। আমাদের বেকার তরুণরা একটি চাকরির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, বিদেশ যাওয়ার জন্য সর্বস্ব বিক্রি করছে, অন্যদিকে আমাদেরই প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশিদের নিয়োগ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অন্তত ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী তরুণ-তরুণী কর্মক্ষম। যাদের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছর। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হিমশিম খেতে হয়। কর্মে সক্ষম নতুন যোগ হওয়াদের মধ্যে অর্ধেক থেকে যায় বেকার। আবার অদক্ষ, অল্প দক্ষদের বড় অংশ কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এমন বাস্তবতায় করোনার হানা অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এলোমেলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গেল দুই বছরে কর্মহীন, চাকরি হারানো বা বিদেশ ফেরত লোকের সংখ্যা আরও বেড়েছে। নতুন নিয়োগ বা কাজের জোগান বর্তমান অবস্থায় খুবই সীমিত। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে চাকরির বাজার পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা না হওয়ার কারণে কর্মী ছাঁটাই করছে আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই না করলেও নতুন নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে চাকরির পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও শেষ পর্যায় পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। অনেকেই আছেন, যাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বেশিদিন নেই। স্বভাবতই তারাই বেশি উদ্বিগ্ন। বস্তুত করোনা যুব সম্প্রদায়ের হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চালিকাশক্তি। অল্প বা মোটামুটি বিনিয়োগে অধিক কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এই খাত। বাংলাদেশের মতো বিপুল শ্রমশক্তির দেশে বেকারত্ব হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
করোনার প্রভাবে বিশ্বের ছোট, বড় এবং মাঝারি সব ধরনের শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষত সারিয়ে নিতে অনেককেই কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ফলে পৃথিবীর সামনে এক বিশাল বেকারত্ব নামক মহামারী সমস্যা অপেক্ষা করছে। বেকারত্বের কারণে সৃষ্ট সমস্যা সামাল দেওয়া তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়। কারণ বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা বছরের পর বছর চেষ্টার ফল। বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, করোনার সময়ে বিশ্বের অর্ধেক তরুণ-তরুণী উদ্বেগ ও হতাশায় আক্রান্ত। করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই ভুগছেন মানসিক সমস্যায়। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন অথবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষিত তরুণদের বিশাল একটা অংশ বেকারত্বের কারণে হতাশাগ্রস্ত। সদ্য লেখাপড়া শেষ করা নাগরিকদের মাঝে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বেকারত্ব নামক মহামারীর শিকার হচ্ছে। বেকারত্ব একটি সামাজিক ব্যাধি অথবা সংকট। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা একক কোনো সমস্যা নয়, বরং বহুবিধ সমস্যার জনক। এ সমস্যা ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারি সদিচ্ছা জরুরি। বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিক্ষিত ও পরিশ্রমী জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের কাজে উৎসাহী করে তুলতে পারলেই বেকারত্বের বিশাল বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। মহামারীতে মধ্য আয়ের দেশগুলোর তরুণরা সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছেন। বেকারত্ব ঘোচাতে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টাও করছেন অনেকে। অবৈধ পথে যাওয়ার কারণে মৃত্যুর পাশাপাশি গ্রেপ্তারও হতে হচ্ছে তাদের। সম্প্রতি ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সাত বাংলাদেশির মৃত্যু হয়।
আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব থাকলেও কর্মক্ষম বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের বেশিরভাগই তরুণ। বলা যায়, তারুণ্যে ভরপুর একটি দেশ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তরুণ জনগোষ্ঠীর এ সুবিধা যদি কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করবে। এই জনগোষ্ঠীকে বোঝায় পরিণত না করে কাজে লাগানোর সব ধরনের ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের কোনো দেশই বেকারত্ব থেকে মুক্ত নয়। উন্নত বিশ্বেও বেকারত্ব রয়েছে। তবে তাদের বেকারত্ব আর আমাদের দেশের মতো উন্নয়নকামী দেশের বেকারত্বের ধরন এক নয়। অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব মোকাবিলার বিষয়টি নিয়ে তাই এখনই ভাবতে হবে। ভাবতে হবে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠন নিয়েও। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বেকারত্বের সমস্যা দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে হবে।

Collected from dainikamadershomoy