পদ্মা নদীর ওপারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কমবে ১ শতাংশ। ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমলে এর প্রভাব পড়বে সারা দেশে। তখন জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার কমবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ একাধিক সংস্থার গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
এই সেতু কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে সেতুটি চালু হলে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হবে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতি। দক্ষিণাঞ্চল ঘিরে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এতে বাড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আকৃষ্ট হবেন। সার্বিক এসব কর্মকাণ্ডে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, এই সেতুর কারণে জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়বে। এশীয় হাইওয়ের সঙ্গেও যুক্ত হবে সেতুটি। এটি চালু হলে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হবে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতি।
প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের বেশি বেড়ে যোগ হবে জাতীয় আয়ে। কারণ পদ্মা সেতুর সঙ্গে ওই অঞ্চলের অনেক অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে দক্ষিণ বাংলার রাস্তাঘাট, টোল প্লাজাসহ সবকিছুতে বড় রকমের উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এসব উন্নয়ন বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে এবং বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। সাবেক এই গভর্নর মনে করেন, পদ্মা সেতুর সুফল পুরোপুরি পেতে হলে দক্ষিণ বাংলায় নেয়া মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে মোংলা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্পে গতি আনতে হবে।
জানা গেছে, যমুনার ওপর দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারের এই সেতু উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ সহজ করে। ফলে বগুড়া বা রংপুরের কৃষক সকালে ক্ষেত থেকে যে সব্জি তোলেন, মধ্যরাতে তা ঢাকায় পৌঁছায়। রাজশাহীর মৎস্যচাষীদের তাজা রুই মাছ রাজধানীর বাজারে বাজারে বিক্রি হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে উত্তরের মতো ফসলের বাড়তি দাম পাওয়া যাবে বলে মনে করেন দক্ষিণের কৃষকেরা। তাদের এই আশার দিকটি উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত মে মাসের এক সমীক্ষায়।
প্রসঙ্গত, সর্বশেষ সংশোধিত ব্যয় অনুযায়ী সেতু নির্মাণে মোট খরচ হবে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আগামী ২০২২ সালের জুনে সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হতে পারে। পদ্মা রেল সেতুর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সড়ক সেতুতে যে অর্থ বিনিয়োগ হবে তার বিপরীতে মুনাফার হার বছরে দাঁড়াবে ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশে সাধারণত বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফার হার ১৫ শতাংশ। পদ্মা সেতুতে এ হার বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে, এটি বহুল ব্যবহৃত একটি অবকাঠামো হবে। যে কারণে এ থেকে রাজস্ব আয় ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাড়তে থাকবে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ২০০৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের অর্থনৈতিক প্রভাব বা ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন (ইআরআর) দাঁড়াবে বছরে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে সেটা বাড়তে পারে।
জানতে জাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে অর্থনীতিতে এর বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জিডিপিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঘটবে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর ও পদ্মা লিংক রেল এই তিনটি দক্ষিণাঞ্চলে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে। এছাড়া ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যে যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা হচ্ছে। এতে সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে দেশের প্রধান অর্থনীতির সঙ্গে পায়রা ও মোংলা বন্দরের সুফল যুক্ত হবে। সেখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
পদ্মার ওপারে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬ জেলা, ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, পোপালগঞ্জসহ মোট ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। বদলে যাব দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার অর্থনৈতিক চিত্র। ইতোমধ্যেই এ অঞ্চলে বেসরকারি বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা জাজিরা প্রান্ত থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ঘিরে এবং আশপাশের এলাকায় জমি কিনতে শুরু করেছেন। ফলে জমির দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে।
পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক থেকে ভাঙ্গা উপজেলার তিনদিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। এর একটি বরিশাল, একটি খুলনা অংশে, আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর, বেনাপোলে। এ তিনটি সড়ক যুক্ত হবে মোংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে। ফলে তিন বন্দর দিয়েই আমদানি পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে।
এতে রফতানি পণ্যের লিড টাইম (ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরির পর রফতানি করতে যে সময় লাগে) কমে যাবে। ফলে দ্রুত ব্যবসার রিটার্ন বা মুনাফা পাওয়া যাবে। এতে অর্থের চলাচল বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত। সেতুর মাওয়া অংশ থেকে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করবে। এভাবে সারা দেশে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে বছরে গড়ে যানবাহন চলাচল করবে প্রায় ৩৫ হাজার। এ থেকে রাজস্ব আয় হবে ৮২২ কোটি টাকা। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ৩৯ হাজারে দাঁড়াবে। রাজস্ব আয় হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ২০৩০ সালে তা আরও বেড়ে ৫৮ হাজারে যানবাহন চলবে।
রাজস্ব আয় হবে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। ২০৩৫ সালে তা আরও বেড়ে ৬৬ হাজার যানবাহন এবং রাজস্ব আয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এভাবে ২০৫০ সালে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে ৭৬ হাজার। রাজস্ব আয় বাড়বে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
COLLECED FROM JUGANTOR