Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ

সিনিয়র সিটিজেনদের সমন্বয়ে গঠিত পর্যটন বিষয়ক অলাভজনক সংস্থা ‘কাছে এসো’র উদ্যোগে আমরা প্রায়শই দেশের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে থাকি। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি জামালপুর গিয়েছিলাম। জামালপুর কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত, তা আগেই শুনেছিলাম। আমি জামালপুর যাবার পর কয়েকজন কারুশিল্পীর সঙ্গে কথা বলি। একটি রাস্তার দু’পাশে অন্তত ৫০টি শো-রুম রয়েছে যেখানে কারুপণ্য বিক্রি করা হয়। সেখানেই আলাপ হলো, জামালপুর জেলা হস্তশিল্প এসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি ও জামালপুর জেলা উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের আহবায়ক ডা. সাঈদা আক্তারের সঙ্গে।

তিনি জানালেন, বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী উদ্যোক্তা রয়েছে জামালপুরে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড জামালপুর এলাকার ৫০০জন নারী উদ্যোক্তাকে সহজ শর্তে বিনা জামানতে ঋণ প্রদান করে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আরো প্রায় ১ হাজার ৮০০ নারী উদ্যোক্তাকে ব্যাংক ঋণ প্রদান করা হয়। ঋণের কিস্তি আদায়ের হার প্রায় শতভাগ। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংকই নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না। অথচ সরকার নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন এবং অর্থায়নের জন্য পর্যাপ্ত পলিসি সাপোর্ট দিয়েছেন। এগুলো কাজে লাগিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব। তিনি বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন ও বিকাশের জন্য সরকারের দেওয়া নীতি সহায়তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে নারী উদ্যোক্তাগণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।

বাংলাদেশের নারীরা অত্যন্ত সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। তারা যেকোনো কাজে পুরুষের সমান দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম। সরকার নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে যেসব নীতি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন, তা কাজে লাগিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সম্ভব। কিন্তু এক শ্রেণির ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাদের ঋণদান এবং অন্য সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে এখনো ততোটা উদার নয়। সহজ অর্থায়ন প্রাপ্তি নারী উদ্যোক্তাদের একটি বড়ো সমস্যা। অর্থায়নের অভাবে নারী উদ্যোক্তাগণ ঠিকমতো বিকশিত হতে পারছেন না। এমনকি অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তাই জানেন না, তাদের জন্য সরকার কী সুবিধা প্রদান করেছে। বাংলাদেশে যারা নারী উদ্যোক্তা, তাদের অধিকাংশই কুটির শিল্প এবং অতি ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা। তারা আগে এসএমই (স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) এর আওতাভুক্ত ছিলেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসএমই সেক্টরের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। কুটির এবং অতিক্ষুদ্র শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করে এই খাতের নতুন নামকরণ করা হয়েছে, ‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রিজ ‘(সিএমএসএমই)’। মন্ত্রীপরিষদের সাম্প্রতিক এক সভায় নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণদানের প্রস্তাব পাশ হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানত দেওয়া একটি কঠিন কাজ। কারণ নারীরা চাইলেই স্বামী অথবা পৈত্রিক সম্পত্তির মালিকানা পেতে পারেন না। এজন্য তাদের অনেক দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই ব্যাংক ঋণদানের সময় যখন সম্পত্তি বন্ধক নিতে চায়, তখন নারী উদ্যোক্তারা পিছিয়ে যান।

অবশ্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে নারী উদ্যোক্তাদের তুলনামূলক কম সুদে জামানতবিহীন ঋণ দিচ্ছে। এসএমই ফাউন্ডেশন গত অর্থবছরের শেষের দু’ মাসে সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এই ১০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের। চলতি অর্থবছরে এসএমই ফাউন্ডেশন ২০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করবে, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ বা ৬০ কোটি টাকা দেওয়া হবে নারী উদ্যোক্তাদের। একজন উদ্যোক্তা ১ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারছেন। এরমধ্যে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য কোনো জামানত দিতে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন আগে সার্বিকভাবে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণদানের ক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়েছে। প্রচলিত ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও নারী উদ্যোক্তারা ৫ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘স্মল এন্টারপ্রাইজ খাতে পুন: অর্থায়ন স্কিম’ এর আওতায় স্বল্প সুদে ঋণ পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তহবিল থেকে অগস্ট, ২০২১ পর্যন্ত ২৯ হাজার ৮৬৩ জন নারী উদ্যোক্তা ৩ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন। ২০২৪ সালের মধ্যে এই খাতে প্রদত্ত ঋণের অন্তত ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

নারী উদ্যোক্তাদের সমস্যা এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাগণ অত্যন্ত সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারি। তারা যেকোনো কঠিন কাজও দেখে দেখে শিখে নিতে পারেন। তবে তাদের অর্থায়ন প্রাপ্তিতে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যে সব নীতি সহায়তা দিয়েছেন, সে সম্পর্কে নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই অবহিত নন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানালেন, চলতি অর্থবছরে পিকেএসএফ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে। পিকেএসএফ’র ৫ লাখ টাকা হতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ গ্রহণের জন্য কোনো জামানত দিতে হয় না। তবে পিকেএসএফ এর ঋণদান পদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। সাধারণ ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান যেভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণদান করে তাতে দারিদ্র্যমোচন হয় না।

বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা থেকে ঋণ নেবার পর ৯ থেকে ১১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে আসতে পারে। তাও টেকসইভাবে নয়। যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাক ঘটলে তারা আবারো দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে আসতে পারেন। এ সমস্যা সমাধানের জন্য পিকেএসএফ ‘উপযুক্ত ঋণ’ কার্যক্রম চালু করেছে। উপযুক্ত ঋণ হচ্ছে সেই ঋণ যা একজন মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী দেওয়া হয়। হয়তো একটি ছাগলের খামার প্রতিষ্ঠা করতে ১০ লাখ টাকা লাগবে, তাকে দশ লাখ টাকাই দেওয়া হবে। অন্য একজনের ছাগলের খামার করতে হয়তো ৭ লাখ টাকা প্রয়োজন তাকে ৭ লাখ টাকাই দেওয়া হবে। কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ দানের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ দেয়। এতে অর্থের চাহিদা পূরণ না হলে ঋণ গ্রহণকারী অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে।

এভাবে তারা ঋণজালে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু উপযুক্ত ঋণের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণদানের ক্ষেত্রে প্রথমেই তার চাহিদা জরিপ করে অর্থাৎ প্রকল্পটি স্থাপন ও পরিচালনায় কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে, তা অনুসন্ধান করে। এরপর সেই মোতাবেক ঋণদানের ব্যবস্থা করে। তবে উপযুক্ত ঋণদানের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার মধ্যেই দায়িত্ব শেষ করা হয় না। ঋণদানের আগে সংশ্লিষ্ট বর্ণিত কাজের জন্য উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষিত করা হয়। কীভাবে তুলনামূলক স্বল্প খরচে গুণগতমান সম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করতে হয়। কীভাবে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ করতে হয়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এমনকি উৎপাদন পর্যায়েও প্রকল্পের কার্যক্রম ফলো-আপ করা হয়। উৎপাদনের কোনো পর্যায়ে যদি সমস্যা দেখা দেয়, তা সমাধানের ব্যবস্থা করা হয়। উপযুক্ত ঋণদানের মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তার টেকসই দারিদ্র্যমোচন সম্ভব।

বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে নারীবান্ধব সরকার হিসেবে পরিচিত। নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নানাভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটেও নারী উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। যেসব নারী উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার ৭৫ লাখ টাকা তাদের কর মওকুফ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে ৫০ লাখ টার্নওভারের উপর কর মওকুফ সুবিধা পাওয়া যেতো। সরকারের নারী উন্নয়ন কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীরা আরো বেশি অবদান রাখতে পারবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সাল থেকে ‘কৃষি ও পল্লী ঋণ’ নামে এক বিশেষ ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই ঋণদান কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় কৃষি নির্ভর শিল্প গড়ে তোলা। এই ঋণের সুদের হার ব্যাংকের প্রচলিত ঋণের সুদের হারের চেয়ে এক শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ খাতে ২৮ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই ঋণ কার্যক্রমেও গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তাদের সুবিধার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে সিডিউল ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় আলাদা নারী ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। এখান থেকে নারী উদ্যোক্তারা তাদের ঋণ এবং অন্যান্য সহায়তা পেতে পারেন। (পিআইডি ফিচার)

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে