Facebook Youtube Twitter LinkedIn
...
চা-শ্রমিকদের মজুরি-রেশন নিয়ে এই অপপ্রচার কেন

চা–শ্রমিকেরা যখন দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন, ঠিক তখন মালিকেরা বলছেন, তাঁরা নাকি চা–শ্রমিকদের ৪০২ মজুরি দেন। তাঁদের এই তথ্য দিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা স্পষ্টতই অসত্য এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল। চা-শ্রমিকদের মজুরি ও রেশন নিয়ে প্রকৃত সত্য বা বাস্তবতা এখানে ব্যাখ্যা করা হলো।

১. মালিকেরা বলছেন, তাঁরা দৈনিক ঘরভাড়া বাবদ ৭৬ দশমিক ৯২ টাকা, চিকিৎসা বাবদ ৭ দশমিক ৫০, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ শূন্য দশমিক শূন্য ২, এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪ টাকা শ্রমিকদের দেন, যা দাঁড়ায় ৯৮ দশমিক ৪৪ টাকা। বাস্তবে এটা ধোঁকাবাজি।

শ্রম আইনের ২(৪৫) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসাসুবিধা, অবসর ভাতা বা ভবিষ্য তহবিলে মালিক কর্তৃক দেওয়া টাকা মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না। এ কারণে মালিকেরা উপরিউক্ত খাতগুলোতে যে টাকা মজুরি বাবদ প্রদান করছেন বলে দেখাচ্ছেন, তার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। আবার শ্রম আইনে স্পষ্ট নির্দেশ আছে, চা–শ্রমিকদের গৃহায়নের সুবিধা নিশ্চিত করবেন মালিকেরা (৯৬ নং ধারা)।

এখানে মনে রাখতে হবে চা–শিল্প অন্য শিল্পের মতো নয় যে বাইরে থেকে শ্রমিক এনে কাজ করানো যায়। চা–শিল্পের বিশেষ ধরনের কারণেই শ্রমিকদের বাগানেই থাকতে হয়। আর এই বাগানও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাষ করছেন চা–শ্রমিকেরা। মালিক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু শ্রমিকেরা সেখানেই আছেন। এ কারণে চা–শ্রমিকদের গৃহে উৎপাদিত, কাঁঠাল বা পেয়ারাজাতীয় ফলের মূল্য মজুরিতে দেখানো হাস্যকর যুক্তি ছাড়া আর কী হতে পারে?

২. মালিকেরা দেখাচ্ছেন, প্যাকিং বোনাস, মাঠ বা কারখানায় অধিক কাজের জন্য দৈনিক ৬৫ টাকা দেন। এটা বাস্তবে সাধারণ দৈনিক মজুরি নয়। এটা শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের টাকা। শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় অধিক কাজে সাধারণ হারের দ্বিগুণ মজুরি প্রদানের কথা আছে। এ কারণে এগুলোকে দৈনিক মজুরিতে দেখানো মানে শ্রমিক ঠকানো।

৩. মালিকেরা বলছেন একজন শ্রমিককে সপ্তাহে ১০ দশমিক ৬১৫ কেজি চাল বা আটা দেওয়া হয়। যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩০ দশমিক ৭৯ টাকা। কিন্তু বাস্তব হলো একজন পুরুষ শ্রমিককে ৩ দশমিক ২৭০ কেজি রেশন দেওয়া হয়, তাঁর পোষ্য নারী শ্রমিককে দেওয়া হয় ২ দশমিক ৪৪ কেজি, শিশুকে ১ দশমিক ২২ কেজি (যদি শিশু থাকে)। এসব মিলে হয় ৬ দশমিক ৯৩ কেজি। নারীরা পোষ্যের জন্য রেশন পান না। কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। অন্য সেক্টরে যাঁরা রেশন পান, সেটাকে মজুরি হিসেবে দেখানো হয় না। যেমন পুলিশ সদস্য রেশন পান, এটা মজুরি বা বেতন হিসেবে গণ্য হয় না।

৪. বছরে দুটি উৎসব ভাতা ও কাজে উপস্থিতি অনুযায়ী বার্ষিক উৎসব ভাতা দেওয়া হয়। মালিকেরা এ ভাতাকে দৈনিক মজুরির সঙ্গে (৪ দশমিক ৬০+১৫ দশমিক ৪৫ টাকা) হারে যুক্ত করে দেখাচ্ছেন, যা বাস্তবে অন্যায়। কারণ, শ্রম আইনের আওতায় প্রণীত শ্রম বিধিমালায় বলা আছে, প্রতিটি উৎসব ভাতা মাসিক মজুরির অধিক হবে না এবং তা অতিরিক্ত মজুরি হিসেবে বিবেচিত হবে না।
তাহলে মালিকপক্ষ এ টাকাকে কেন মজুরিতে যুক্ত করে দেখাচ্ছেন?
আর যদি ধরে নিই, চা–শ্রমিকেরা দৈনিক ৪০৩ টাকা মজুরি পান, তাহলে আইন অনুযায়ী উৎসব বোনাস হবে (৩০*৪০৩=১২০৯০*২=২৪১৮০) টাকা প্রায়। এটা কি মালিকেরা দেন?

৫. মালিকেরা বলছেন, চা–শ্রমিকদের প্রতিবছরে অর্জিত ছুটি (১৪ দিন) বাবদ দৈনিক ৪ দশমিক ৬০ টাকা দেওয়া হয়। এটাও প্রতারণামূলক কথা। শ্রম আইন অনুযায়ী চা–শ্রমিকেরা প্রতি ২২ দিনে ১ দিন করে সবেতন ছুটি পান (১১৭–এর ১(খ)ধারা)। এ দিনগুলোর মজুরি শ্রমিকের আইনত অধিকার। এমনকি যদি শ্রমিক ছুটি ভোগ নাও করেন, তার বিপরীতে এই দিনগুলোর মজুরি তিনি দাবি করতে পারেন। এ টাকাগুলোকে দৈনিক মজুরির সঙ্গে যুক্ত করে দেখানো প্রতারণার শামিল।

এভাবে মালিকদের উত্থাপিত প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করা যায়। কিন্তু এতটুকুতেই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে মনে হয়। তাই আসুন, চা–শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হই। চা–শ্রমিকদের এই দাবি আদায়ে সমাজের সব স্তরের সচেতন ও বিবেকবান মানুষের উচিত তাঁদের পাশে দাঁড়ানো।

প্রতিক্রিয়া
সঞ্জয় কান্ত দাস
সংগঠক
চা–বাগান শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ

Collected from Prothom alo