১১ আগস্টের ডেইলি স্টার-এর খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের অস্থিরতা কাটাতে বৈদেশিক মুদ্রার নীতিমালা শিথিল করেছে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। তবে চুক্তি হওয়ার পর কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে, সে-সম্পর্কিত তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক চুক্তি সইকারী বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের চিঠি দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা-ও তুলে নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত ছয় অর্থবছরের মধ্যে প্রথম ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ শতাংশ প্রবাসী আয় কমেছে। ৯ আগস্ট পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৩৯ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার, গত বছরে একই তারিখে যা ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশের বেশি আসে প্রবাসী আয় থেকে। আর রপ্তানির পর এ রেমিট্যান্সই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন উপজেলায় নির্মিত ২৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন দেশে আমাদের যারা কর্মরত শ্রমিক, তাদের অর্থ প্রেরণে যাতে সুবিধা হয়, সেই সুবিধাটা সৃষ্টি করে দিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ার পেছনে সরকারের ভুল নীতি ও সিদ্ধান্তও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। প্রবাসীদের কাছ থেকে সরকার দুইভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পেয়ে থাকে। এক. প্রবাসী শ্রমিকেরা তাঁদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল দেশে বসবাসকারী স্বজনদের কাছে নিয়মিত অর্থ পাঠান। দুই. দেশে প্রবাসীদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি। জাতীয় সংসদে আইন করে প্রবাসীদের জন্য দুটি বন্ড চালু করা হয়েছিল খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে। কিন্তু ২০২০ সালে সরকার নির্বাহী আদেশে সেই আইন অদলবদল করে বিনিয়োগের সীমা এক কোটি টাকার সীমা বেঁধে দেয় এবং পুনর্বিনিয়োগের সুবিধাও তুলে নেয়।
সরকারি হিসেবে বর্তমানে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে কাজ করেন। এদের বেশির ভাগ অদক্ষ এবং মালয়েশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাকরি করেন। এই শ্রমিকদের আয় কম হলেও দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের পুরো টাকাটাই পাঠান। অনেকের ধারদেনা শোধ করতেও অনেক বছর লেগে যায়। এরা খুব বেশি বিনিয়োগ করতে পারেন না। কিন্তু চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, পরামর্শকসহ যেসব প্রবাসী তুলনামূলক বেশি বেতনে চাকরি করেন, তাঁরা তাদের আয়ের একটা বড় অংশ দেশে পাঠান বিনিয়োগ হিসেবে। তারা বিনিয়োগ করেন বৈদেশিক মুদ্রায়। এখানে ফেরত পান দেশীয় মুদ্রায়। অনেকে বাড়ি-জমি-ফ্ল্যাট কেনায় বিনিয়োগ না করেও সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করেন। কেননা আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে প্লট বিক্রি করলেও শেষ পর্যন্ত সব ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন না। বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এসব কারণে অনেক প্রবাসী জমি বা প্লট না কিনে প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু সরকারের তুঘলকি সিদ্ধান্তের কারণে অনেকে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিলেন। বিনিয়োগও মারাত্মকভাবে কমে যায়।
গত ৬ এপ্রিল প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, সরকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের মুনাফার হার প্রায় অর্ধেক কমিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। দুটি বন্ডেই এত দিন চার স্তরে মুনাফা দেওয়া হয়েছে। এখন স্তর করা হয়েছে তিনটি। আগে বন্ড দুটিতে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার সমমূল্যের ডলার বিনিয়োগ করা গেলেও সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে ১ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে প্রথম বছর শেষে এত দিন ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যাবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা। একইভাবে দ্বিতীয় বছর শেষে ৭ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ এবং তৃতীয় বছর শেষে ৭ দশমিক ৫ শতাংশের বদলে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ পাওয়া যাবে।
এ ছাড়া ১ লাখ ১ থেকে ৫ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করে প্রথম বছর শেষে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ৪ শতাংশ ও তৃতীয় বছর শেষে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে। আর ৫ লাখ ১ ডলার থেকে তার বেশি অর্থ বিনিয়োগের বিপরীতে প্রথম বছর শেষে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ৩ শতাংশ ও ৩ বছর শেষে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে।
এদিকে ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে ১ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে প্রথম বছর শেষে ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বদলে ৪, দ্বিতীয় বছর শেষে ৬ শতাংশের বদলে ৪ দশমিক ৫ আর তৃতীয় বছর শেষে ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে। ১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, অনাবাসী বৈদেশিক মুদ্রার বেঞ্চমার্ক রেফারেন্স রেটের সঙ্গে নতুন করে দেওয়া সুদের হার যোগ হবে। তাতে এক থেকে তিন বছর মেয়াদি ডলার আমানতের ওপর বেঞ্চমার্ক রেফারেন্স রেটের সঙ্গে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদহার প্রযোজ্য হবে। অন্যদিকে ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত সময়ের জন্য বেঞ্চমার্ক রেফারেন্স রেটের সঙ্গে ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদ যোগ হবে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের চালু করা আরও একটি বন্ড রয়েছে। এর নাম ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড। এ বন্ডের মুনাফার হার ও স্তর কমানো সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। এ বন্ডে ৫ বছর শেষে মুনাফার হার ১২।
বন্ডে বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া, নবায়নের সুবিধা তুলে নেওয়া ও করোনার ধাক্কায় বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগ কমে আসছিল। বিষয়টি সম্প্রতি সরকারের নজরে আসে। উল্লেখ্য, সরকার ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনটি বন্ডে প্রবাসীদের প্রতিজনের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা এক কোটি টাকা বেঁধে দেয়। আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিয়োগ নবায়নের সুবিধাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে ইউএস ডলার বন্ডে বিনিয়োগের সীমা তুলে দেওয়া হলেও পুনর্বিনিয়োগের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। আবার প্রবাসী বন্ডের সুবিধা কে পাবেন, কে পাবেন না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে।
বিদেশগামী জাহাজে কর্মরত এক বাংলাদেশি নাবিক ই-মেইলে আরেকটি সমস্যা কথা জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বিদেশগামী জাহাজে কর্মরত, যা বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাভুক্ত নয়। এ বিবেচনায় আমরা “ওয়েজ আর্নার” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার এক বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে কয়েক শ্রেণির ওয়েজ আর্নারদের বন্ড (বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা সঞ্চয়পত্র) কেনার অধিকার বাতিল করে, যার মধ্যে নাবিকেরা অন্তর্ভুক্ত।’ ওই নাবিকের যুক্তি হলো ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড যেহেতু বৈধভাবে আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে কিনতে পারার কথা, তাই বর্তমানে অনুমোদিত বিভিন্ন গ্রাহক বা ক্রেতার মতো আমরা তথা নাবিকেরাও এটার ক্রেতা হওয়ার যোগ্য। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গঠনে অন্য প্রবাসীদের মতো নাবিকদেরও ভূমিকা আছে, তাই উপরিউক্ত সুবিধার তাঁরাও ন্যায্য পাওনাদার।
বাহরাইন থেকে এক প্রবাসী লিখেছেন, প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে দুভাবে টাকা পাঠিয়ে থাকেন। বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে ডলার এবং সাধারণ হিসাবে টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে পাঠানো ডলার দিয়ে ওয়েজ আর্নার বন্ড কেনা যায়। ওয়েজ আর্নার রি-ইনভেস্টমেন্ট ব্যবস্থা চালু ছিল ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। এরপর হঠাৎ করে সরকার রি-ইনভেস্টমেন্ট ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। সরকার একই সঙ্গে বন্ড কেনার পরিমাণ এক কোটি টাকায় সীমিত করে দেয়। পরে এক কোটি টাকার সীমা তুলে নেওয়া হলেও রি-ইনভেস্টমেন্ট সুবিধা পুনর্বহাল করা হয়নি। এ কারণে প্রবাসীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। রি-ইনভেস্টমেন্ট সুবিধা থাকায় অনেক প্রবাসী জমি বা বাড়ি না কিনে বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন এবং তাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এসেছে। কিন্তু দেশে পুনর্বিনিয়োগের এ সুবিধা না থাকলে অনেকে দেশে না এনে যেসব দেশে বিনিয়োগ সহজতর, সেসব দেশে চলে যাচ্ছেন।
কেবল ওই প্রবাসী নন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত কয়েক প্রবাসীর সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরাও একই অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁদের দাবি, সরকার যদি প্রবাসীদের বিনিয়োগ চায়, তাহলে সরকারের উচিত হবে প্রবাসী বিনিয়োগ বন্ডের সব বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া। তাঁদের পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া। দেশে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা পেনশনসহ অনেক সুবিধা পান। পুরো কর্মজীবন বিদেশে কাজ করে যাঁরা দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করেছেন, তাঁদের বিনিয়োগে কেন এত বিধিনিষেধ।
Collected from Prothom alo